Monday, April 29, 2013

নিউ ইয়র্কে মাজলিসুল উলামার মতবিনিময় সভা


                  


নিউ ইয়র্কে মাজলিসুল উলামার মতবিনিময় সভা
হেজাত ইসলাম ঘোষিত ১৩ দফা বাস্তবায়ন 
এবং মাহমুদুর রহমানের মুক্তি দাবী




নিউ ইয়র্ক: নিউ ইয়র্কের ইমাম, আলেম ও বিভিন্ন মসজিদের পরিচালনা কমিটির মতবিনিময় সভায় বক্তারা হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবীর প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেন, ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে হয়তো মুসলমানরা থাকবে, নয়তো নাস্তিকরা থাকবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের তৌহিদী জনতাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বক্তারা বলেন, হেফাজতে ইসলামের ঘোষিত দাবীসমূহ বিজ্ঞান ও বাস্তব সম্মত। সংবিধান পরিবর্তন করে হলেও হেফাজতে ইসলাম ঘোষিত ১৩ দফা বাস্তবায়ন করতে হবে। সভা থেকে আমার দেশ পত্রিকা প্রকাশ ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মুক্তির দাবী করা হয়। এছাড়াও ৫ মে’র ঢাকা অবরোধ প্রতি সভা থেকে সমর্থন জানানো হয়।
২৮ এপ্রিল রোববার নিউ ইয়র্কের ব্রুকলীনে বায়তুল জান্নাহ মসজিদের মাজলিসুল  উলামা ইউএসএ’র উদ্যোগে এ মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।  
সভায় মাওলানা মুফতী রুহুল আমীনের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন মুফতী আব্দুল মালেক, ইমাম আব্দুর রহমান, ইমাম জাকারিয়া মাহমুদ, ইমাম আজিরুদ্দিন, মুফতী লুৎফুর রহমান ক্বাসিমী, মাওলানা আবু সুফিয়ান, মুহাম্মদ ইসমাইল, মুফতী খালেদ কাউসার, মাওলানা আব্দুল্লাহ কামাল, ইমাম ইব্রাহিম খলিল, মাওলানা আসাদ, মাওলানা জুনায়েদ হোসাইন। 
সভা পরিচালনা করেন মাজলিসুল উলামা ইউএসএ’র সভাপতি মাওলানা রফিক আহমদ। 
নিউ ইয়র্কের বিভিন্ন মসজিদ পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন আসসাফা ইসলামিক সেন্টারের প্রেসিডেন্ট ডা নুরুর রহমান, বায়তুল জান্নাহ ভাইস প্রেসিডেন্ট হেলাল উদ্দিন, মাওলানা দিদারুল আলম, হাজী আখলাক মিয়া, হাজী মাহমুদ আলী, বায়তুস শরাফ মসজিদের গোলাম হোসেন, ব্রুকলীন ইসলামিক সেন্টারের প্রেসিডেন্ট আমিনুর রসুল জামসেদ, জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ডা. জুন্নন চৌধুরী, বায়তুল মোর্কারম মসজিদের মঈন শরীফ, মদিনা মসজিদের জুহাইব ও নোমান রহমান, ডা. ফজলুল হক, আবু সামীহাহ সিরাজুল ইসলাম, সাইফুল্লাহ বেলাল, ইফনা সেক্ট্রেটারী মির্জা মশিউর রহমান প্রমুখ। আলেমদের মধ্যে আরো উপস্থিত ছিলেন, হাফিজ মুজাহিদুল ইসলাম, হাফিজ রফিকুল ইসলাম, মাওলানা আশ্রাফ উল্লাহ, হাফিজ সিদ্দিক প্রমূখ। 
এছাড়াও সভায় নিউ ইয়র্কের অর্ধশতাধিক মসজিদের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় আগত মসজিদ প্রতিনিধিদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন মুফতী রুহুল আমীন ও মাওলানা আবু সুফিয়ান। 
সভা শেষে সাভারে ভবন ধসে শহীদদের রূহের মাগফেরাত কামনায় এবং আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মুক্তি ও সুস্থতার জন্য বিশেষ দোয়া মুনাজাত করেন মাওলানা আব্দুর রহমান। 
সভাপতির বক্তব্যে মুফতী রুহুল আমিন বলেন, কোরান হাদিস অনুযায়ী ইসলাম, আল্লাহ ও রাসূল (সাঃ) শানে কোন ব্যক্তি বেয়াদবি করলে সে মুসলমান থাকতে পারেনা। মুরতাদ হিসেবে তার শাস্তি হবে  মৃত্যদন্ড। এজন্য রাসূল (সাঃ) অবমানকারীর নতুন কোন আইন দরকার হবেনা। প্রচলিত আইনে মুরতাদদের বিচার করা সম্ভব। কোন মুরতাদকে মুসলমান সমর্থন করতে পারেননা, সমর্থনকারী ব্যক্তিও মুরতাদ হয়ে যান।  
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় সবসময় ইসলামের উপর আঘাত আসে। তারা ইসলাম বিরোধী কোন আইন করবে না বলে ক্ষমতায় এসেই সংবিধান থেকে আল্লাহর আস্থা বিশ্বাস স্থাপন করা এবং বিসমিল্লাহ বাদ দিয়েছে। পরিকল্পিতভাবে পাঠ্য পুস্তুকে কোরান হাদিসকে বিকৃত করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধী বিচারের কথা বলে সরকারের মনগড়া ট্রাইবুনাল গঠন করে মানবতা বিরোধী বিচার নামে বাংলাদেশ থেকে ইসলাম নিমূর্লের ষড়যন্ত্র করছে।  
তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের অধিকাংশ মন্ত্রী এমপি স্বঘোষিত নাস্তিক। তারা কখনো ইসলামের মঙ্গল চাইতে পারেনা। তারা বাংলাদেশে রাষ্ট্র ধর্ম ইসলামকে বাদ স্বরোচিত মতবাদ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। 
আমার দেশ প্রকাশনা পূনরা চালু ও মাহমুদুর রহমানের মুক্তির দাবী করে তিনি বলেন, মাহমুদুর রহমান সরকারের নাস্তিকবাদী মুখোশ উম্মোচন করে দিয়েছে। তাই প্রতিহিংসা মূলক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে হত্যার ষড়যন্ত্র চলছে। অবিলম্বে মাহমুদুর রহমানের মুক্তির দাবী করেন তিনি। 
মুফতি আব্দুল মালেক বলেন, ওমরাহ হজ্ব পালন করতে গিয়ে সৌদি আরবের আলেমদের বেশ কয়েকটি সভা করেছি, সেখানের আলেমরা বাংলাদেশে রাসূল কটাক্ষকারীদের বিচার দাবী করেছে। তারা বাংলাদেশে নাস্তিকদের বিভিন্ন অপতৎপরতা বিষয়ে সৌদি আরবে লিফলেট ছাপিয়ে দেশব্যাপী বিতরণ করছে। এছাড়াও বাংলাদেশে আলেম উলামাদের হত্যা ও মানবাধিকার লংঘনের ঘটনায় উদ্বিগ্ন বলে জানিয়েছে সৌদি আরবের আলেমরা। 
সৌদি আরব সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে তিনি বলেন, সৌদি বাদশা ঘোষিত ২ কোটি শ্রমিকের জটিলতা সমস্যায় ৩ মাসের অন্তবর্তীকালীন সময় অন্যান্য দেশের শ্রমিকরা সুযোগ সুবিদা পেলেও বাংলাদেশের শ্রমিকরা পাচ্ছেননা। কারণ হিসেবে মূলত তারা বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক সংকটকে দায়ী করেছেন। 
তিনি বলেন, সরকার পরিকল্পিতভাবে কতিপয় নাস্তিকদের মাধ্যমের আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে সংঘাত সৃষ্টি করা হয়েছে। ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশ হয়েও ধর্মীয় স্বাধীনতা নেই। এ অবস্থায় দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইসলাম ও বাংলাদেশকে বাঁচাতে হবে। 
আমার দেশ ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মুক্তি দাবী করে মাওলানা লুৎফুর রহমান ক্বাসিমী বলেন, আগামী ৫ মে’র মধ্যে মাহমুদুর রহমানের মুক্তি দিতে হবে। অন্যথায় তৌহিদী জনতা মাহমুদুর রহমানকে মুক্ত করে আনবে। 
মাওলানা আজির উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশে এখন দুইটি অংশ, একটি হেফাজতে ইসলাম আরেকটি হেফাজতে নাস্তিক। নাস্তিকদের সমর্থন করাও নাস্তিক উল্লেখ করে  তিনি বলেন, ফরিদ উদ্দিন মাসুদের মতো ব্যক্তিকে এখন আর আলেম বলার সুযোগ নেই। 
আবু সামীহাহ সিরাজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে একটি গোষ্ঠি ইসলামি রাজনীতি নিষিদ্ধ এবং ধর্ম নিরপেক্ষতাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে প্রচার করে থাকেন, অথচ মুক্তিযুদ্ধের সময় কোথাও এসব তথাকথিত দাবী ছিল বলে কেউ প্রমাণ দেখাতে পারেনা। 

সংবাদ প্রেরক
মাওলানা মুফতী লুৎফুর রহমান ক্বাসিমী
দাওয়া গবেষাণা ও শরিয়া মুখপাত্র
মাজলিসুল উলামা ইউএসএ



Tuesday, April 23, 2013

প্রথমবার আমার দেশ যেভাবে বন্ধ করা হয়েছিল




প্রথমবার আমার দেশ যেভাবে বন্ধ করা হয়েছিল
খোমেনী ইহসান: সপ্তাহে আমার ছুটির-দিন হল মঙ্গলবার। সাধারণত বাইরে যাই না, সপ্তাহে একটা দিন ছুটি, একটু অলস সময় কাটাই। ফলে জুনের এক তারিখেও বাসা থেকে বার হওয়ার কথা ছিলো না। দুপুরের খাবার খেয়ে শুয়েছিলাম। পৌনে তিনটার দিকে বন্ধু রাকিব--দৈনিক ডেসটিনির কূটনৈতিক প্রতিবেদক বন্ধু রাকিব-উন-নবী ফোন দিয়া বললো, কী রে তোদের পত্রিকা নাকি বন্ধ হয়ে গেছে? তারপর ও নিশ্চিত করেই বললো যে, এটা হবে আজই। ওকে কী আর বলবো? বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। কই এমন আভাস ইঙ্গিতও তো পাই নাই, গতকালও!

মানিক ভাইকে ফোন দিলাম--আহমদ হোসেন মানিক, আমার দেশ পাবলিকেশন্স লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার। তিনি বললেন--ফোনে কথা বলা যাবে না। তার কথায় বুঝলাম--ঘটনা তাহলে ঘটে যাচ্ছেই। বাসা থেকে দৌড়ে বের হলাম। বাসে চেপে কাওরান বাজার, অফিসে।

ঘড়িতে তখন বিকাল সাড়ে চারটা। অফিসে ঢুকেই জানলাম, পত্রিকার প্রকাশক হাসমত আলীকে সকাল ৯টায় জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা-এনএসআই-এর সদস্যরা ধরে নিয়ে গেছে। তার কাছ থেকে দুইটা সাদা কাগজে সই রেখে দুপুর দুইটার দিকে ছেড়ে দিছে। কিন্তু তাকে বাসায়ও পাওয়া যাচ্ছে না। অফিসে বিষাদ ও ক্ষোভের ছায়া। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বিকাল ৫টায় সংবাদ সম্মেলন করবেন বলে জানালেন। সহকর্মীরা সবাই প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে, আজই দৈনিক আমার দেশ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মাহমুদ ভাইও গ্রেফতার হচ্ছেন।

সংবাদ সম্মেলনের খবর জোগাড় করতে নানা সংবাদমাধ্যমের প্রচুর সাংবাদিকরা আসলেন। অনেক পরিচিত মুখ। বন্ধু কিম্বা বড় ভাই, ছোটো ভাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগের আমার সিনিয়র জুবেরী ভাই--ইংরেজি দৈনিক নিউ এজের সিনিয়র রিপোর্টার, তিনিও এসেছেন। তার চোখে-মুখে স্পষ্ট বিরক্তি ও ক্ষোভের ছাপ। সংবাদকর্মী হিশাবে অন্য একটা সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবর জোগাড় করতে আসা নিশ্চয় কোনো সুখের ব্যাপার না। বিষণ্ণ সবাই। কেউ কেউ আমাদের সান্ত্বনা দিলেন। গায়ের জোরের ওপর এই সরকারের নির্ভরতার কথা বললেন, যাচ্ছেতাই করে যাওয়ার মানসিকতার কথা বললেন। টের পেয়েছি, শিড়দাঁড়া বেয়ে একটি গোপন দীর্ঘশ্বাস নামছে। নীচে, অনেক নীচে, অনিশ্চিত গন্তব্যের পথে।

সংবাদ সম্মেলনে মাহমুদ ভাই কী বললেন, প্রচণ্ড ভীড়-ভাট্টায় তার পুরাটা কানে ঢুকল না, অনেক পেছনে ছিলাম আমি। শুধু কানে বাজলো--‘সরকার গতকাল রাতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ১০ দিনের মধ্যে আমার দেশ বন্ধ করে দেবে ও আমাকে গ্রেফতার করবে। তাদের হুকুমে এনএসআই-ডিজিএফআই’র মতো গোয়েন্দাসংস্থাগুলো আজ মাঠে নেমেছে।

সময় গড়াতে থাকলো। পুরা আমার দেশ নিরবতার কুণ্ডলিতে চলে যেতে থাকলো। ধীরে ধীরে ভীড় বাড়তে শুরু করলো শুভাকাঙ্ক্ষীদের। আমাকে অবাক করে দিয়ে রাত ১০ টার দিকে ছোটো ভাই মুনতাসির ও মারুফ আসলো, ব্যাগে করে কাপড়-চোপড় নিয়ে। ওরা শুনেছে আমাকে গ্রেফতার করা হতে পারে। ওদের দেখে মনটা আরো বিষণ্ণ হয়ে গেল। যতোই বলি কিছুই হবে না, ওরা দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলতে পারে না। ওদের ধারণা মাহমুদুর রহমানের সঙ্গে আমার দেশ থেকে সব সাংবাদিককেই পুলিশ গ্রেফতার করবে।

১১টা বেজে গেল। শুনলাম পুলিশ ওপররে দিকে আসছে । কিছুক্ষণের মধ্যে এসেই গেল। উর্দি পরা ও সাদা পোষাকধারী। উর্দিপরাদের বেশিরভাগ দাঙ্গা পুলিশ। আর্মড পুলিশ ও ব্যাটালিয়নও আছে। লিফট বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ। আমরা দরজায় দাঁড়িয়ে গেলাম। রিপোর্টার মাহাবুবুর রহমান, সহ-সম্পাদক আরীফ মুহাম্মদ, সহ-সম্পাদক এমদাদ, রিসার্চ সেলের শহিদুল, পিয়ন সাইফুল ও রাজা প্রবেশ পথে দাঁড়িয়ে গেল। আমরা সাফ জানিয়ে দিলাম--এভাবে জোর করে মাহমুদুর রহমানকে ধরে নিয়ে যাওয়া যাবে না। সিনিয়র সাংবাদিকরা সহ সবাই দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে গেলাম মানব দেয়াল হয়ে। পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধের প্রতিবাদে মুহুর্মুহু শ্লোগান দিতে থাকলাম সবাই, কলম বন্ধ, ভাবছিলাম আবার এই কলমের বাঁধ খুলতে কতো শ্লোগান দিতে হবে রাজপথে কে জানে!
পুলিশ বারবার জোর করে ভেতরে ধেয়ে আসতে চাইলেও আমাদের বাধার কারণে ব্যর্থ হচ্ছিলো। ওদিকে মাঝরাত পার হয়ে যাচ্ছে। ক্যালেন্ডারের হিসাবে ২ জুন রাত ১টা বাজে তখন। ক্ষুধায় সবাই কাহিল। পুলিশ নীচে থেকে কাউকে উঠতে দিচ্ছে না, নামতেও না। খাবার নিয়া আসার কোনো উপায় নাই। পানির লাইন বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ। ফিল্টার জার কয়েকটাতে যা পানি ছিলো তা থেকেই একটু একটু করে খাচ্ছিলো সবাই। আমাদের হাউসের লোকজন ছাড়াও অন্যান্য হাউস থেকে নিউজ কাভার করতে আসা প্রায় অর্ধশতের বেশি সাংবাদিকও ছিলেন। সবাই খিদা আর পিপাসায় কাতর।

টিকতে না পেরে তাই একজন পিয়নকে পাঠানো হলো নিচ থেকে খাবার ও পানি আনার জন্য। পিয়ন খাবার ও পানি নিয়ে নিচে অপেক্ষা করতে থাকল। কিন্তু তাকে উপরে ওঠতে দেয়া হচ্ছে না। সে উপরের সবার অবস্থা জেনে বেশ করে কাকুতি-মিনতি করল। কাজের কাজ হল না। উল্টা খাবার কেড়ে নিয়ে তাকে আচ্ছা মতো পেটানো হল। এক সময় আমার দেশ-এর টেলিফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হলো। ওদিকে বারবার তার প্রবেশ পথে হামলে পড়ছে পুলিশ। বুট-হেলমেট ও বন্দুক সমৃদ্ধ পুলিশের শক্তির সামনে যেন আমাদের শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধের দেয়ালটা একটু একুট করে ভেঙ্গে পড়ছে।

রাত গভীর থেকে গভীর হচ্ছে। একদিকে নিরস্ত্র সংবাদকর্মী। আরেক দিকে সশস্ত্র পুলিশ। ফারাকটা যেন শুধু অস্ত্রের, মাঝখানে রাষ্ট্র-সংবিধান-আইন বলে কিছু নাই। সংবাদকর্মীদের রক্ষাকবচ সাংবিধানিক নাগরিক অধিকার ও আইনের দোহাই। পুলিশের হাতে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস সংঘটনের মারণাস্ত্র। উপরের নির্দেশে পুলিশের দল জ্বি স্যার, জ্বি স্যার করতে করতে ভেঙ্গে পড়ছে। কিন্তু তিনটায়, চারঘণ্টায় অসংখ্যবার হামলা করেও তারা প্রতিরোধের দেয়াল টপকাতে পারছে না। একটা পর্যায় পরিস্থিতি এমন হলো মারমুখী পুলিশের চোখে-মুখে হিংস্রতার দাগগুলো গাঢ় হয়ে গেল। আমরা সংবাদকর্মীরাও প্রবেশ পথে আরো গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে শক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। শ্লোগান চলছে। শ্লোগান জুড়ে রক্ত দেয়ার, জান দেয়ার ঘোষণা ধ্বনি।

গুজব বাড়ছে। গুঞ্জন বাড়ছে। পুলিশ কর্মকর্তাদের মোবাইল ফোন ও ওয়াকিটকির ব্যস্ততা বাড়ছে। প্রচন্ড আবেগ আমাদের হৃদয়কে দুমড়ে-মুচড়ে দিচ্ছে। আমার দেশ, আমাদের কর্মস্থল না। নিছকই একটা সংবাদপত্র মনে করা যায় না আমার দেশকে। এ যে আমাদের ভালোবাসা। প্রেম। না, আমার বুকের ছাতি ফুলে ওঠলো। ইতিহাসের যতো নিষ্ঠুরতম ঘটনাই ঘটুকনা কেন প্রতিরোধ চলবে। চরম আবেগে আমরা কেঁপে গেলাম। শ্লোগান বন্ধ। সবাই গেয়ে ওঠলাম জাতীয় সংগীত ও রণ সঙ্গীত। আবারো শুরু হলো শ্লোগান। শ্লোগানে আমার দেশ-এর ছাদ কেঁপে কেঁপে ওঠছে। জ্যৈষ্ঠ-কনিষ্ঠ সব সংবাদকর্মীই দৃঢ় অবস্থান গড়ে তুললাম। এই শ্লোগানের তোড়ে একসময় সব পুলিশ আমাদের অভ্যর্থনা চত্বর থেকে বের হয়ে সিঁড়ির কাছে চলে গেল। আমার দেশ যেহেতু আগুনে নিজের প্রাণশক্তিকে বাংলাদেশে মূর্ত করে তুলেছে, সেহেতু আমরা পিশাচের কৌশল ও শঠতার সঙ্গেও পরিচিত ছিলাম। সবাই বুঝে গেল কিছুক্ষণের মধ্যে পুলিশ শক্তি প্রয়োগ করতে শুরু করবে।

সময় ৩ টা ১৭। নিষ্ঠুরতার রাতে চূড়ান্ত আঘাতটি পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে। হঠাৎ করেই শতাধিক দাঙ্গা পুলিশ-আর্মড পুলিশ হামলে পড়লো প্রবেশ পথে। আমরা সবাই প্রাণপণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে চেষ্টা করলাম। দরজার এপাশ ধরে আমরা, ওপাশ ধরে ওরা। বড় জোর ৫-৭ মিনিট। এরপর আর আমরা পারি নাই। আমরা ক্ষুধার্ত একদল মানুষ আর কতক্ষণ পারি! সামনে ছিলেন যারা তাদের--মাহবুব ভাই, আরীফ, এমদাদ ও সাইফুলকে টেনে হেচড়ে নিয়ে গেল সশস্ত্র উর্দিওয়ালারা। দরজার ওপাশে নিয়েই লাঠির আঘাত, বুটের লাথি আর অশ্রাব্য গালি। আঘাতে জর্জরিত হয়ে লুটিয়ে পড়লেন ওরা। দেখলাম টেনে হিচড়ে তাদের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামিয়ে নেয়া হচ্ছে। আর সামনে থেকে লাঠি-বন্দুক উচিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো শতাধিক পুলিশ। সামনে যাকেই পেল, তাকেই মারতে মারতে এগোলো--উপ-সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ, নগর সম্পাদক জাহেদ চৌধুরী ও আলাউদ্দিন আরিফ ভাই মার খেয়ে মেঝেতে পড়ে গেলেন।


চোখের সামনে দেখলাম, উর্দি ছাড়া ক’জন গুন্ডামতো লোক পিস্তল বাগিয়ে সামনে চলে আসছে। তারা উর্দিওয়ালা পুলিশদের নির্দেশ দিচ্ছে লাঠিচার্জ করতে। ওরা আমাদের বসার চেয়ারগুলো আমাদের গায়ের উপর ছুঁড়ে মারতে লাগলো। সামনে যা কিছু পেল সব চুরমার করেই ওরা ভেতরে ঢুকে ডান দিকে মাহমুদ ভাই’-র রুমের দিকে ধেয়ে গেলো। পেছন থেকে আমরা চিৎকার করে স্লোগান দিতে থাকলাম। ততক্ষণে প্রবেশ পথের লাইট নিভিয়ে দিয়েছে ওরা। পুরো আমার দেশ কার্যালয় জুড়ে ভীতির ছাপ। পুলিশ লাঠি-বন্দুক তাক করে আমাদের ঘেরাও করে রেখেছে। মাহমুদ ভাইয়ের কাছে যেতে দিচ্ছে না। সেখানে তার সঙ্গে পুলিশের কী কথা হলো, না হলো কিছুই জানতে পারছি না।

দীর্ঘক্ষণ পর দেখলাম ভোর চারটার দিকে মাহমুদ ভাইকে ঘিরে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে সশস্ত্র উর্দিওয়ালারা। মাহমুদ ভাই হাত উচিয়ে আমাদের বিদায় জানাতে জানাতে বেরোলেন হাসিমুখে। স্লোগানের বদলে তখন আমাদের চোখে পানি। ডাকাতের মতো রাতদুপুরে সশস্ত্র পুলিশ আর সাদা পোশাকধারী ভয়ংকর মানুষগুলা আমাদের ওপর হামলে পড়ছিলো সন্ধ্যা থেকে--কিন্তু আমরা তো হতাশ হই নাই তখন! এই কান্না আসলে অপমানের নয়, একজন সম্পাদকের সাহস আর আমাদের সবাইকে বাঁচিয়ে দিয়ে চলে যাওয়া দেখে।
তিনি যেভাবে যাচ্ছিলেন তাতে মনে হতে লাগলো তিনি প্রচন্ড নির্বোধ কোন মানুষকে সততা ও সাহসের মাধ্যমে জব্দ করতে যাচ্ছেন। তিনি আবারও আমাদের মাঝে ফিরবেন। আবারও আমার দেশ প্রকাশিত হবে। পুলিশি রাষ্ট্রের এই ডাকাতের গ্রামে যেই রাত্রি আমাদের ওপর চেপে বসেছিল- সেই রাত্রির আঁধারবিস্তারী অপশাসনের বিরুদ্ধে আবারো লড়বে আমার দেশ।


Monday, April 22, 2013

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে আমার দেশের অপরাধ নেই




তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে 
আমার দেশের অপরাধ নেই

  
লেখক: মোহাম্মদ আরজু

যেই মামলার সূত্র ধরে দৈনিক আমার দেশের ছাপাখানা সীলগালা করে ও অন্য কোথাও থেকে পত্রিকাটি ছাপতে না দিয়ে সরকার এটি কার্যত নিষিদ্ধ করে রেখেছে, সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে যেই মামলায় এবার গ্রেফতার করা হলো, এই মামলাটি ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে দায়ের করা হয়েছিল গত বছরের ডিসেম্বরে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬-এর ৫৬ ও ৫৭ ধারা ও দণ্ডবিধির ১২৪, ১২৪-এ, ৫০৫এ, ১২০বি ও ৫১১ ধারায় গত ১৩ ডিসেম্বর এই মামলাটি দায়ের করা হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান এই মামলায় পত্রিকাটির প্রকাশক হাসমত আলীকেও আসামি করেন।

এতে রয়েছে দুই ধরনের অভিযোগ; প্রথম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নিজামুল হক নাসিমের কম্পিউটারে হ্যাকি করে তার স্কাইপ কথোপকথন ও ইমেইলসহ মিথ্যা-অশ্লীল তথ্য প্রকাশ এবং তা প্রকাশের মাধ্যমে রাষ্ট্রদ্রোহ। 

ট্রাইব্যুনালটির চেয়ারম্যান বিচারাধীন বিষয় ও সম্ভাব্য রায় নিয়ে দিনের পর দিন কথা বলেছেন ট্রাইব্যুনাল বহির্ভুত এক ব্যক্তির সঙ্গে। আদালতের কাগজপত্র তাকে পাঠিয়েছেন, তার কাছ থেকে পরামর্শ নিয়েছেন। স্কাইপ যোগে আলাপের অডিও ও ভিডিও রেকর্ড নিজেদের কাছে থাকা সূত্র হিসেবে উল্লেখ করে খবরটি প্রথম দেয় বৃটিশ সাময়িকী দি ইকনমিস্ট। দৈনিক আমার দেশ ওই কথোপকথনের অনেকাংশ প্রকাশ করে।  পরে ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, একজন গ্রাহকের ফরমায়েশ অনুসারে সংশ্লিষ্ট বিচারক ও ট্রাইব্যুনাল বহির্ভূত ব্যক্তির আলাপালোচনা ‘সংগ্রহ’ করেছে আমেরিকার একটি বেসরকারি গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠান। অবশ্য সংশ্লিষ্ট ‘গ্রাহকে’র নাম প্রকাশে করেনি তারা গোয়েন্দা সংস্থাটি।

বিচারকের শপথ ভঙ্গ করে বিচারাধীন বিষয় নিয়ে বাইরে আলাপ করার এমন কেলেঙ্কারি ফাঁস হলে ট্রাইব্যুনাল ছাড়েন চেয়ারম্যান নিজামুল হক নাসিম। অবশ্য তার বিরুদ্ধে এখনো কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগে পূর্ববর্তী পদে বিচারক হিসেবে ফেরত গিয়েছেন তিনি।

এদিকে টানা কয়েকদিন স্কাইপ কেলেঙ্কারি প্রকাশের পর গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এক আদেশে বলেন, বাংলাদেশের গণমাধ্যমে এই ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো। চেয়ারম্যান ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল তাদের ওই আদেশের অনুলিপি ইকনমিস্ট ও আমার দেশের সম্পাদক এবং বিটিআরসি ও তথ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

একইদিনে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের অভিযোগে ‘আমার দেশ’ পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে হাই কোর্ট বিভাগে আবেদন করেন এক আইনজীবী। বিভাগের বিচারক এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও ফরিদ আহমেদের যুগ্ম বেঞ্চে ওই আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আজহারুল্লাহ ভূঁইয়া। শুনানি শেষে আদালত তার রুলে বলেন, স্কাইপ কথোপকথন ‘হ্যাকিং’ ও তা প্রকাশে দায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের এবং গ্রেপ্তারের কেন নির্দেশ দেয়া হবে না তা জানাতে হবে। স্বরাষ্ট্রসচিব, আইজিপি এবং দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানসহ সংশ্লিষ্টদের দু’সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলেন আদালত। একইসঙ্গে দৈনিক আমার দেশ ছাপা ও প্রকাশনায় আইনের কোন ধারা লঙ্ঘন করেছে কি না তা খতিয়ে দেখতে ঢাকার জেলা প্রশাসককে বলেন বিচারকদ্বয়। 

সেদিনই মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে দায়ের করা মামলায় ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমানের আইনজীবী বলেন, ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৬ ও ৫৭ ধারার অধীনে গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ করেছেন আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান।

আইনটির ৫৬ ও ৫৭ ধারায় কি বলা হয়েছে তা দেখে নেয়া যাক। আইনটির ৫৬ ধারার শিরোনাম হচ্ছে ‘কম্পিউটার সিস্টেমের হ্যাকিং সংক্রান্ত অপরাধ ও উহার দণ্ড’ । এখানে বলা হয়েছে; 
কোনো ব্যক্তি যদি ১. (ক) জনসাধারণের বা কোন ব্যক্তির ক্ষতি করিবার উদ্দেশ্যে বা ক্ষতি হইবে মর্মে জ্ঞাত হওয়া সত্ত্বেও এমন কোন কার্য করেন যাহার ফলে কোন কম্পিউটার রিসোর্সের কোন তথ্য বিনাশ, বাতিল বা পরিবর্তিত হয় বা উহার মূল্য বা উপযোগিতা হ্রাস পায় বা অন্য কোনভাবে উহাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে; (খ) এমন কোন কম্পিউটার, সার্ভার, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা অন্য কোন ইলেক্ট্রনিক সিস্টেমে অবৈধভাবে প্রবেশ করার মাধ্যমে ইহার ক্ষতিসাধন করেন, যাহাতে তিনি মালিক বা দখলকার নহেন; তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি হ্যাকিং অপরাধ। ২.  কোন ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন হ্যাকিং অপরাধ করিলে তিনি অনধিক দশ বৎসর কারাদণ্ডে, বা অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

আইনটির ৫৭ ধারায় ‘ইলেক্ট্রনিক ফরমে মিথ্যা, অশ্লীল অথবা মানহানিকর তথ্য প্রকাশ সংক্রান্ত অপরাধ ও উহার দণ্ড’ শিরোনামে বলা হচ্ছে (১) কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েব সাইটে বা অন্য কোন ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি প্রদান করা হয়, তাহা ইহলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ। (২) কোন ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন অপরাধ করিলে তিনি অনধিক দশ বত্সর কারাদণ্ডে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

বিচারকের স্কাইপ কথোপকথন আমার দেশ হ্যাক করেছে বলে এযাবত কোনো প্রমাণের দাবি করেনি সরকার। নিউ এজ’র প্রতিবেদনে অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বেসরকারি গোয়েন্দা সংস্থা ‘গার্ডিয়ান কনসাল্টিং এলএলসি’ বলছে, বাংলাদেশে নিযুক্ত তাদের লোকেরা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক চেয়ারম্যান বিচারক নিজামুল হক এবং বেলজিয়ামভিত্তিক বাংলাদেশী আইনজীবী আহমেদ জিয়াউদ্দিনের স্কাইপে এবং ই-মেইল আলাপের কপি সংগ্রহ করেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ‘অপকর্মের ব্যাপারে নজর রাখার’ জন্যই তাদের ভাড়া করা হয়েছিল বলে জানায়। এক্ষেত্রে সংস্থাটির জন্য যারা কাজ করেছে বা তথ্য সংগ্রহ করেছে তাদের কেউই কোনো আইন লঙ্ঘন করেনি বলেও দাবি করেছে ওই গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠানটি।

এর বাইরে স্কাইপ কথোপকথন ও ইমেইল সংগ্রহের বিষয়ে আর কোনো তথ্য দেয়নি দি ইকনমিস্ট বা আমার দেশ। মাহমুদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে তার কার্যালয় ও আমার দেশ’র ছাপাখানা থেকে কম্পিউটার ইত্যাদি জব্দ করেছে সরকার। তারপর রিমান্ডে নিয়ে তাকে দৃশ্যত ব্যাপক নির্যাতনও করা হয়েছে। এরপরও সরকার দাবি করতে পারেনি যে, আমার দেশ এই হ্যাকিং বা সংগ্রহ কাজে জড়িত ছিলো। ফলে হ্যাকিং বেআইনি হলেও ‘বেআইনিভাবে’ পাওয়া তথ্য প্রকাশে আইনে যেহেতু কোনো বাধা নেই- কাজেই কোনো অপরাধ নেই আমার দেশের।

এরপর থাকে ৫৭ ধারার বিষয়। কিন্তু না সরকার না কোনো আদালত কখনো দাবি করেনি যে এই স্কাইপ কথোপকথন ঘিরে প্রকাশিত খবর ‘মিথ্যা’। সংশ্লিষ্ট বিচারক তো ট্রাইব্যুনালে শুনানিকালে একবার এটা স্বীকারই করেছেন যে তিনি ওই লোকের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাছাড়া এসব খবর ‘অশ্লীল’ অথবা ‘জনসাধারণকে নীতিভ্রষ্ট করতে পারে’ অথবা ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা’ বা ‘আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটা’নোর মত খবরও নয়। কিছু খবর কারো ‘ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন’ করে কি?  কিন্তু কোনো খবর যদি জনস্বার্থে করা হয়, তা যদি সত্য হয়, তাতে আইনত কারো ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করা হয়না। বরং জনস্বার্থ এক্ষেত্রে প্রাধান্য পায়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করছিল এমন একটি অনিয়মের খবর প্রকাশ নিঃসন্দেহে জনস্বার্থের দিক থেকে খুব দরকারি ছিল।
সূত্র: আরটিএনএন (http://www.rtnn.net//newsdetail/detail/1/3/62626#.UXXkWrXvtac)


বাংলাদেশে ভারতের যুদ্ধ ও ইসলামী জাগরণ



বাংলাদেশে ভারতের যুদ্ধ ও ইসলামী জাগরণ




লেখক: ফিরোজ মাহবুব কামাল



শেষ হয়নি শত্রুর যুদ্ধ

শত্রুর যুদ্ধ কখনোই শেষ হয়না। শত্রু শুধু রণাঙ্গন ও কৌশল পাল্টায়।বাংলাদেশের ভারতের যুদ্ধ তাই শেষ হয়নি,তারা শুধু কৌশল পাল্টিয়েছে। যুদ্ধ দুটি ভিন্ন রূপে আসে। কখনো রক্তাক্ষয়ী অস্ত্রযুদ্ধ রূপে। কখনো স্নায়ু যুদ্ধ বা কোল্ড ওয়ার রূপে। অস্ত্রের যুদ্ধটি সীমান্তে হয়। আর স্মায়ুযুদ্ধ বা বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধটি হয় দেশের অভ্যন্তরে,এবং ঘরে ঘরে ও রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে।এবং সেটি অবিরাম ভাবে। এ যুদ্ধটি যেহেতু স্নায়ু বা চেতনার রাজ্য জুড়ে হয়,এ যুদ্ধকে তাই স্মায়ুযুদ্ধও বলা হয়।এ যুদ্ধে অস্ত্র রূপে কাজ করে বুদ্ধিবৃত্তি ও শিক্ষাসংস্কৃতি –তাই এটি বুদ্ধিবৃত্তিক বা সাংস্কৃতিক যুদ্ধও।অস্ত্র ব্যবহৃত না হলেও এ যুদ্ধের নাশকতা কম নয়। বিগত একশত বছরে মুসলিম দেশগুলির সবচেয়ে বড় বড় পরাজয়গুলি হয়েছে বুদ্ধিবৃত্তির যুদ্ধে। এবং সে পরাজয়ের ফলে মুসলিম বিশ্বের ভৌগলিক মানচিত্রের সাথে পাল্টে গেছে চেতনা ও সংস্কৃতির মানচিত্রও। এ রণাঙ্গনে জিততে হলে যোদ্ধার বুদ্ধিবৃত্তিক বলটা অপরিহার্য।



স্নায়ু যুদ্ধে অস্ত্র রূপে কাজ করে ধ্যানধারণা,মতবাদ বা দর্শন।যুদ্ধ হয় শিক্ষা,সংস্কৃতি,বুদ্ধিবৃত্তি, মিডিয়া ও রাজনীতির ময়দানে। বিশ্বরাজনীতির ময়দান থেকে কম্যুনিজমকে বিলুপ্ত করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ন্যাটো মিত্রদের একটি তীরও ছুড়তে হয়।অপরদিকে মুসলমানগণ তাদের আদর্শিক,রাজনৈতীক ও সামরিক বল হারিয়েছে জাতিয়তাবাদ,সমাজতন্ত্র,কম্যুনিজম,লিবারালিজম ও সেক্যুলারিজমের ন্যায় মতবাদগুলির হামলায়। সে হামলায় শক্তিহীন হয়েছে এবং অবশেষে ভেঙ্গে গেছে উসমানিয়া খেলাফতের ন্যায় দীর্ঘকালের বিশ্বশক্তি। মুসলমানগণ তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বলটি সর্বশেষ বার দেখিয়েছে পাকিস্তান সৃষ্টির প্রাক্কলে। মাওলানা মহম্মদ আলী জওহার, আল্লামা কবি ইকবাল,কবি হালী, আশরাফ আলী থানবী,শিবলী নোমানী,সোলায়মান নদভীর মত এক ঝাঁক মুসলিম জ্ঞানী ব্যক্তির আবির্ভাব হয়েছিল ব্রিটিশ-শাসনাধীন ভারতে। অবাঙালী মুসলমানদের সে বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ বাংলাতেই আঘাত হেনেছিল। পাকিস্তান অর্জিত হয়েছিল তো সে বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায়,কোন সামরিক শক্তি বলে নয়।



কিন্তু বাংলাদেশে ইসলামপন্থিরা সে যুদ্ধে পরাজিত হতে শুরু করে ১৯৪৭য়ের পর থেকেই। কারণ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ইসলামপন্থিদের বুদ্ধিবৃত্তিক বলটি ছিল অতি সামান্যই। অথচ ভারতের বিনিয়োগটি এক্ষেত্রে ছিল বিশাল ও পরিকল্পিত। বর্তমান স্নায়ুযুদ্ধ বা কোল্ডওয়ারটি মূলত ভারতের ১৯৪৭ পরবর্তী সে বিনিয়োগেরই ধারাবাহিকতা। এ যুদ্ধের মাধ্যমেই ভারত বাংলাদেশের রাজনৈতীক, সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক মানচিত্রে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছে। সে লক্ষ্য পুরণে সীমান্তে ভারত সৈন্য সমাবেশ না ঘটালেও,দেশের অভ্যন্তরে লক্ষ লক্ষ সৈন্য দিবারাত্র নিয়োজিত রেখেছে। সে যুদ্ধেরই কৌশল রূপে ভারত বাংলাদেশে শুরু করেছে ডি-ইসলামাইজেশন প্রজেক্ট। বাংলাদেশ তার বর্তমান মানচিত্রটি ভাষা বা জলবায়ুর কারণে পায়নি। একই বাংলা ভাষা ও একই বাংলার জলবায়ু পাশ্ববর্তী পশ্চিম বাংলার বহু কোটি বাঙালীর জীবনেও আছে। পশ্চিম বাংলার জনসংখ্যার দশমাংশ জনসংখ্যা নিয়ে বিশ্বের প্রায় শতাধিক দেশ স্বাধীন আছে। কিন্তু তারা আলাদা স্বাধীন দেশ পায়নি। বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিতের মূল ভিত্তিটি দেশটির ১৫ কোটি মানুষের আলাদা ধর্মীয় বিশ্বাস। সেটি ইসলাম। ভারত সে ভিত্তিটাই ধ্বসিয়ে দিয়ে চায়। আর ভিত্তিতে ধ্বস নামলে শুধু প্রাসাদই নয়,দেশও ধ্বসে পড়ে। সে ধ্বসাতেই বাংলাদেশে জোরে শোরে কোল্ড ওয়ার বা স্মায়ু যুদ্ধ শুরু হয়েছে। এ কোল্ড ওয়ারের ফ্রন্ট লাইন যোদ্ধা হলো শত শত নাস্তিক ব্লগার।তারা ব্যবহার করছে ইন্টারনেটের ন্যায় আধুনিক প্রযুক্তিকে। তারা যেমন ভারতে আছে,তেমনি বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও আছে। নাস্তিক ব্লগারদের সাথে রয়েছে শত শত নাস্তিক মিডিয়াকর্মী,কলামিস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অঙ্গণ,টিভি নেটওয়ার্ক,বহু এনজিও অফিস,বহু পত্র-পত্রিকার দফতর,এমনকি বহু সরকারি অফিস মূলত এসব ভারতপন্থিদের হাতে অধিকৃত ভূমি।সেখান থেকে হামলা হচ্ছে বাংলাদেশের অন্যান্য অঙ্গনে। হামলার লক্ষ্য শুধু ইসলামের মৌল বিশ্বাস,জিহাদী চেতনা ও কোরআন-হাদীসের শিক্ষা নয়, বরং খোদ মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর প্রিয় নবীরাসূল। তাদের সে বীভৎস প্রচারণা সম্প্রতি জনসম্মুখে প্রচারও পেয়েছে। তারা সে প্রচারণার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশীদের ইতিমধ্যে মুরতাদ বানিয়ে ছেড়েছে।ইসলামে বিশ্বাসীদের রাজনীতিকেই শুধু নয়,তাদের শারিরীক উপস্থিতিও বাংলাদেশের মাটিতে তারা মেনে নিতে রাজী নয়।



একাত্তরের ভারত আওয়ামী লীগ,ছাত্রলীগ ও মস্কোপন্থি কম্যুনিস্টদের বহু হাজার নেতাকর্মীকে নিজ দেশের অভ্যন্তরে নানা স্থানে নিয়ে দীর্ঘদিন ট্রেনিং দিয়েছিল। লক্ষ্য এ ছিল না যে,তাদেরই কাজ একাত্তরে পাকিস্তান ভাঙ্গার মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। শিক্ষা বা ট্রেনিংয়ের আছড় কি ৯ মাসে শেষ হয়? এমনকি কুকুর-বিড়ালের ন্যায় ইতর জীবকে একবার পোষ মানানো হলে আজীবন তারা পোষমানাই থেকে যায়। তারা বিদ্রোহ করে না। মানুষও তেমনি শিক্ষালয়ে যে শিক্ষা বা ট্রেনিং পায় তা নিয়ে মৃত্যুর পূর্বদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকে এবং সে অনুযায়ী কাজ করে। শিক্ষার গুরুত্ব এত অধীক বলেই নামায-রোযা ফরয করার আগে ইসলাম বিদ্যার্জনকে ফরয করেছে। মিশনারিরা তাই মুসলিম দেশে এসে শত শত স্কুল-কলেজ খোলে এবং হাজার হাজার মেধাবী ছাত্রদের নিজদেশে বৃত্তি দিয়ে নিয়ে যায়। তাই ভারতে গিয়ে যারা একবার রাজনৈতীক ও সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়েছে তারা ভারতীয় গোলামীর শিকলটি গলা থেকে নামিয়ে আবার স্বাধীন ভাবে দাঁড়াবে সেটি কি এতই সহজ? বাংলাদেশের স্বাধীনতার বড় শত্রু এ মানসিক গোলামরাই।



মানুষ যখন বিপদে পড়ে তখন আপনজনের কোলে গিয়ে আশ্রয় নেয়। কে কাকে কতটা আপন মনে করে সেটি তখন বুঝা যায়। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীগণ ও তাদের রাজনৈতীক মিত্ররা ভারতকে যে কতটা আপন মনে করে সেটি কি শুধু একাত্তরে প্রকাশ পেয়েছে? সেটি যেমন ১৯৭৫য়ে দেখা গেছে,তেমনি আজও নানা ভাবে বুঝা যাচ্ছে।পাকিস্তানের রাজনীতিতে বাংলাদেশ আজ আর কোন আলোচনার বিষয় নয়। পূর্ব পাকিস্তানকে তারা শুধু পাকিস্তানের মানচিত্র ও সংবিধান থেকেই বাদ দেয়নি,স্মৃতি থেকেও বাদ দিচ্ছে।সেদেশে এমন কোন দল নাই যারা বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানভূক্ত করার কথা মুখে আনে। তেমনি বাংলাদেশেও এমন কোন রাজনৈতীক দল নাই যারা পাকিস্তানের সাথে আবার একীভূত হওয়া নিয়ে ভাবে। কিন্তু বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতের যেমন প্রচুর ভাবনা আছে,তেমনি এজেন্ডাও আছে। এজেন্ডার সাথে বিপুল বিনিয়োগও আছে। ২০০৮ সনের নির্বাচনের আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করতে ভারতে বিনিয়োগ কত বিশাল ছিল তার একটি বিবরণ দিয়েছে লন্ডনের বিখ্যাত পত্রিকা“দি ইকোনমিস্ট”।
পাকিস্তান ভাঙ্গাটিই আগ্রাসী ভারতের একমাত্র লক্ষ্য ছিল না। লক্ষ্য হলো,ভারতের পূর্ব সীমান্তে ইসলামী রাষ্ট্র গড়ে উঠাকে যে কোন ভাবে প্রতিরোধ করা। কারণ আদর্শিক রাষ্ট্রের সীমারেখা কোন ভৌগলিক সীমানা দিয়ে সীমিত থাকে না। ভারতে ভয় সে আদর্শ ভারতে ঢুকে পড়া নিয়ে। দেশে দেশে ইসলামের বিপুল জাগরণ দেখে ভারতের সে ভয় আরো বহুগুণ বেড়েছে। তাই ভারতের বিনিয়োগও বেড়েছে। তাই তাদের যুদ্ধটি স্রেফ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয়। বরং সেটি ইসলাম ও মুসলমানের বিরুদ্ধে। ফলে বাংলাদেশের ভূমিতে ভারতের যুদ্ধটি তাই একাত্তরে শেষ হয়নি। বরং যতই বাড়ছে বাংলাদেশে ইসলামের জাগরণ ততই বাড়ছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের বিনিয়োগ ও সংশ্লিষ্টতা।



বাংলাদেশে ভারতের যুদ্ধ

ভারতের শাসকচক্রের প্রচন্ড ভয় দক্ষিণ এশিয়ার বুকে ইসলামী শক্তির উত্থান নিয়ে। তেমনি একটি উত্থান এসেছিল ১৯৪৭ সালে। সে মুসলিম উত্থানের মুলে ছিল ভাষা ও আঞ্চলিকতার উর্দ্ধে উঠে জন্ম নেয়া প্যান-ইসলামিক চেতনা।সে চেতনা নিয়েই ঢাকার বুকে ১৯০৬ সালে জন্ম নেয় মুসলিম লীগ। মুসলিম লীগের নেতৃত্বে জন্ম নেয় পাকিস্তান। ১৯৭১য়ে পাকিস্তান ভেঙ্গে গেলেও চেতনা মারা পড়েনি। ফলে ভারতের যুদ্ধও শেষ হয়নি। কারণ চেতনা বেঁচে থাকলে সে চেতনার ভিত্তিতে দল গড়ে উঠে,আন্দোলনও গড়ে উটে। তাই কোন রাজনীতি বা আন্দোলন দমন করতে হলে চেতনাকে দমাতে হয়।কীরূপে সে ইসলামী চেতনাকে দমন করা যায় সেটি ভারতীয়দের বিদেশনীতির আজও মূল স্ট্রাটেজী। এটা ঠিক যে পাকিস্তানের ব্যর্থতা অনেক। ঘর বাঁধলে তাতে ভয়ংকর শাপও বাসা বাঁধতে পারে। তা ডাকাতদেরও দখলে যেতে পারে। পাকিস্তান আজ আভ্যন্তরীণ শত্রুদের দখলদারির শিকার। কিন্তু তাতে ঘরবাঁধার গুরুত্ব কমে না।তাই পাকিস্তানের বর্তমান সংকট দেখে যারা পাকিস্তানের সৃষ্টিকেই অহেতুক বলে তাদের এ বিষয়টি বোঝা উচিত।তাছাড়া একটি শিশু প্রসবেও প্রচন্ড বেদনা থাকে। আর ইসলামি বিপ্লব ও সভ্যতা প্রসবের বেদনা তো প্রকট ও দীর্ঘকালীন। তাদে বহু মানুষের জীবন ক্ষয় হয়, সম্পদহানিও হয়। সেটি নবীজী (সাঃ)র যুগেও হয়েছে। পাকিস্তান সে প্রসববেদনার মধ্যেই। বাংলাদেশও সে প্রসব বেদনায় প্রবেশ করতে যাচ্ছে। ১৯৪৭ সালের অখন্ড পাকিস্তান বেঁচে থাকলে ইসলামী শক্তির উত্থান যে আরো প্রবলতর ভাবে হতো সে বিষয়টিও ভারতীয় নেতাদের অজানা ছিল না। তাই শুরু থেকেই তারা পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধীতা করেছিল। ১৯৪৭ সালের গান্ধি ও ইন্ধিরা গান্ধির পিতা জওহারলাল নেহেরু পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা রুখতে ব্যর্থ হন। কারণ,সে সময় বঙ্গভূমি থেকে শেখ মুজিব ও তাজুদ্দীনদের ন্যায় ভারতীয় হিন্দুস্বার্থের জন্য কোন সেবাদাস জুটেনি। হোসেন সহরোয়ার্দী,খাজা নাজিমুদ্দীন এবং ফজলুল হকের ন্যায় নেতাগণ তখন মুজিবের ন্যায় আগ্রাসী ভারতের হাতে শিকারি ঘুঘুতে পরিণত হননি। তারা বরং অবাঙালী মুসলমানদের সাথে মিলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় অংশ নেন। ফলে ভারত অপেক্ষায় থাকে পরবর্তী সুযোগের এবং সেটি আসে ১৯৭১য়ে। ফলে সফল হয় মুসলমানদের বিরুদ্ধে একটি কোমরভাঙ্গা যুদ্ধ তৈরী করতে।



ইসলাম বিনাশের একটি গ্রান্ড স্ট্রাটেজীকে সামনে রেখেই ভারত ১৯৭২ সালে তাদের সশস্ত্র সৈনিকদের সরিয়ে নিলেও স্মায়ু-যুদ্ধের কলমধারি যোদ্ধাদের তুলে নেয়নি। বরং বিপুল ভাবে বাড়িয়েছে সে বাহিনীর জনবল। সেটির শুরু শেখ মুজিবের আমল থেকেই। তাই মুজিবের ক্ষমতায় বসানোর পর দেশে কৃষি,শিল্প,রাস্তাঘাট ও আইনশৃঙ্খলায় কোন উন্নয়ন ঘটেনি,কিন্তু প্রচন্ড ভাবে বৃদ্ধি ঘটেছে ছাত্র-শিক্ষক,রাজনৈতিক নেতা-কর্মী,বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়াকর্মীদেরকে ইসলাম থেকে দূরে সরানোর কাজ। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি পরিণত হয় ইসলামের শত্রু তৈরীর বিশাল ইন্ডাস্ট্রিতে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে পাশকরা মগজ ধোলাইকৃত ছাত্রগণ যখন মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর মহান রাসূলকে গালি দিয়ে ব্লগ লেখে,দাড়ি-টুপি-ধারি ব্যক্তিদের ফাঁসি চায়,ইসলামি রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি তোলে -তাতে কি বিস্ময়ের কিছু থাকে? বরং প্রমাণ মেলে ভারতের স্ট্রাটেজী ফল দিয়েছে। শাহবাগের মোড়ে বিগত একমাস ধরে তো সেসব ভারতীয় ফসলদেরই লাগাতর প্রদর্শণী চলছে। তারা শুধু জামায়াত-শিবিরের রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করতে চায় না,নিষিদ্ধ করতে চায় সকল ইসলামপন্থিদের রাজনীতি।রুখতে চায় আল্লাহর আইনের প্রতিষ্ঠা।



লক্ষ্য ইসলামের বিজয়রোধ

আওয়ামী লীগ বিগত ৫ বছর ধরে ক্ষমতায়। এর আগে তারা আরো দুইবার ক্ষমতায় এসেছে। তাদের রাজনৈতীক এজেন্ডা তাই কোন গোপন বিষয় নয়। ইসলামের বিজয় রোধ এবং যে কোন মূল্যে আল্লাহর শরিয়তের প্রতিষ্ঠা রোধই তাদের রাজনীতি।সেটি তারা বার বার নানা ভাবে প্রমাণ করেছে।তাছাড়া দলটির প্রতিষ্ঠাও ইসলামের খেদমতের জন্য হয়নি। বরং এদলটির সকল সামর্থ ব্যয় হয়েছে মুজিব বা হাসিনার ন্যায় যারা ইসলামে অঙ্গিকারশূণ্য তাদের ক্ষমতায় বসানোর কাজে। ইসলামের জাগরণ ঘটলে তাদের রাজনীতি যে ড্রেনে গিয়ে পড়বে সেটি তারা জানে। ফলে নিজেদের রাজনীতি বাঁচাতে তারা কোয়ালিশন গড়েছে দেশ-বিদেশের সকল ইসলামবিরোধী শয়তানি শক্তির সাথে।দিল্লির শাসকচক্রের সাথে শেখ হাসিনার গভীর বন্ধুত্বের কারণ এ নয় যে,তাদের মিলটি ভাষা,পোষাক-পরিচ্ছদ ও খাদ্য-পানীয়ে। বরং সে মিলটি তাদের তাদের রাজনৈতীক এজেন্ডায়। রাজনৈতীক সম্প্রীতি তো গড়ে উঠে এরূপ অভিন্ন এজেন্ডার উপর ভিত্তি করে। এজন্যই ভারতীয় শাসককে মুজিব বা হাসিনার ন্যায় বাঙালী হওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। ইন্দিরা ছিলেন এলাহাবাদের উর্দুভাষী মহিলা। কিন্তু তারপরও মুজিবের সাথে তার প্রচন্ড সখ্যতা জমেছিল। কারণ ইসলাম ও মুসলমানের স্বার্থহানী ঘটাতে উভয়ের রাজনৈতীক এজেন্ডায় ভীষণ মিল ছিল। কিন্তু সে মিলটি বাংলাদেশের কোন ইসলামপন্থি দল বা কোন আলেমের সাথে না থাকায় মুজিব তাদের সাথে তিনি একটি দিনের জন্যও একতা গড়তে পারেননি। ইন্দিরা গান্ধির এজেন্ডা ছিল,ভারতের দুই পাশে বিস্তৃত বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানকে খন্ডিত করা। এবং সুযোগ বুঝে খন্ডিত দুর্বল বাংলাদেশকে ভারতভূক্ত করা। এটিই হলো ভারতীয় রাজনীতির বহুপরিচিত নেহুরু ডকট্রিন। সে লক্ষ্যে একটি রক্তাক্ষয়ী যুদ্ধের জন্য যে কোন ভারতীয় শাসকের ন্যায় ইন্দিরা গান্ধিরও প্রস্তুতি ছিল। কারণ তিনি জানতেন,পাকিস্তান একদিন পারমানবিক শক্তির অধিকারি হবেই। তখন ভারতের পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তে মোতায়েন করা হবে পারমানবিক বোমা বহনকারি দূর পাল্লার বহু ভারি মিজাইল। তখন ভারতের পক্ষে পদ্মা, সুরমা, কুশিয়ারা,তিস্তা, গোমতির পানি ডাকাতি করা সম্ভব হবে না। সম্ভব হবে না বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের বাজার দখল ও অর্থনৈতিক শোষণ। সেটি করতে গেলে অনিবার্য হযে উঠতো পারমানবিক যুদ্ধ।তখন পাকিস্তানের পারমানবিক বোমা হামলার মুখে পড়বে সমগ্র ভারত। সেরূপ একটি পরিস্থিতি সৃষ্টির আগেই ভারত তাই পাকিস্তান খন্ডিত করণে উঠে পড়ে লাগে। সে যুদ্ধটি শুরুর জন্য তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে মুসলিম স্বার্থ-বিরোধী একজন ভারতভক্ত নেতার প্রয়োজন ছিল ইন্দিরার। সে ভূমিকা পালনে ১৯৭১য়ে নিজেকে সঁপে দেয় শেখ মুজিব।



মিত্র ইসলামের শত্রুর

ব্যক্তির আসল পরিচয় জানা যায় তার বন্ধদের দেখে। কারণ প্রত্যেকেই চেতনা-চরিত্রের দিক দিয়ে অতি কাছের মানুষকেই বন্ধু রূপে বেছে নেয়। চোর-ডাকাত,ব্যাভিচারি বা মদ্যপায়ীদের বন্ধুত্ব তাই কোন ঈমানদারের সাথে হয় না। ইসলামের শত্রুপক্ষও তাই কোন আলেম-উলামাকে দলে নেয় না। তাদের সাথে রাজনৈতীক মৈত্রী গড়ে না। ইসলামের শত্রুপক্ষের রাজনীতিতে তাই নাস্তিক কম্যুনিষ্ট, ভারতীয় পৌত্তলিক, আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী ব্লগারগণ আপনজন রূপে গৃহীত হয়। নাস্তিক ব্লগার রাজীব নিহত হওয়ার পর শেখ হাসিনা যেভাবে তার ঘরে ছুটে গিয়েছিলেন সেটি রক্তের টানে নয়। বরং একই আদর্শে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে। বাংলাদেশ শতাধিক ইসলাম প্রেমিক মানুষ নির্মম ভাবে পুলিশের হাতে নিহত হয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনা কি তাদের বাসায় একবারও গিয়েছেন বা তাদের মৃত্যুতে একটি বারের জন্য দুঃখ্য প্রকাশ করেছেন?



ইসলামের চিহ্নিত শত্রুদের সাথে শেখ হাসিনা ও তার পিতার সহযোগিতাপূর্ণ নীতি কোন গোপন বিষয় নয়। বর্তমানে ভারতে বসবাসরত চিত্তরঞ্জন সুতার হলো বাংলাদেশ খন্ডিত করে খুলনা ও বরিশাল বিভাগ এবং ঢাকা বিভাগের বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা নিয়ে স্বাধীন বঙ্গভূমি আন্দোলনের নেতা। ইসলাম ও মুসলমানদের সে ঘোরতর শত্রু। তেমনি মুসলিম বিরোধী চেতনা ছিল মনরঞ্জন ধর ও ফনিভূষন মজুমদারের। অথচ আওয়ামী লীগ এ তিন’জনকেই তাদের দলের এমপি বানিয়েছিল। মনরঞ্জন ধর ও ফনিভূষনকে তো মন্ত্রীও বানিয়েছিল। মনরঞ্জন ধর ছিলেন এক সময় কংগ্রেসের নেতা। ১৯৪৭ সালে অবিভক্ত বাংলার সংসদে বাংলাকে বিভক্ত করে পশ্চিম বাংলাকে ভারতভূক্ত করার পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন জ্যোতি বসু। জ্যোতি বসুদের কারণেই কলকাতা পূর্বপাকিস্তানে আসেনি। অথচ সেই জ্যোতি বসু শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগনেতাদের ঘনিষ্ট বন্ধু। শুধু তাই নয়,শেখ হাসিনা মন্ত্রী বানিয়েছেন ও কোলে টেনে নিয়েছেন বাংলাদেশের রাজনীতির অতি কট্টোর নাস্তিক ও কম্যুনিস্টদের। সংসদে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা বলেছেন,শাহবাগের যুবকদের থেকে তিনি অনুপ্রেরণা পান। নাস্তিক শাহবাগীদের সাহস জোগানোর জন্য সংসদ থেকে একটি প্রতিনিধি দলকেও সেখানে পাঠানো হয়।অথচ শাহবাগের মূল আয়োজক হলো সেসব ব্লগারগণ যারা ইন্টারনেটে দীর্ঘকাল যাবৎ মহান আল্লাহতায়ালা,তাঁর মহান নবী (আঃ) ও নবীজী (সাঃ)র স্ত্রী উম্মেহাতুল মু’মিনদের নিয়ে ইতর ভাষায় যা ইচ্ছে তাই লিখে আসছে। তাদের সে কুকর্ম জনসম্মুখে প্রকাশ পাওয়ায় বাংলার তৌহিদী মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়লেও শেখ হাসিনা ও তার আা্ওয়ামী লীগ সে কুলাঙ্গরদের সমর্থণ দেয়া বন্ধ করেনি। বরং গণধোলাই থেকে বাঁচাতে এসব শাহবাগী নাস্তিক ব্লগারদের দিবারাত্র দেয়া হচ্ছে পুলিশী প্রটেকশন। শেখ হাসিনা তো নিহত ব্লগার রাজীবের বাসায় গিয়ে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার হুমকিও দিয়েছেন। রাজীবকে তথাকথিত দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ রূপে ঘোষণাও দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়,নাস্তিক ব্লগারদের বক্তৃতাকে প্রায় সকল টিভি চ্যানেলে লাগাতর দেখানো ব্যবস্থা করা হয়েছে।



ভারতের প্রতি নিমকহালালীর রাজনীতি

আওয়ামী লীগের রাজনীতি মূলত ভারতের প্রতি নিমকহালালীর রাজনীতি। ১৯৭৫য়ের পট পরিবর্তনের পর শেখ হাসিনা বহুদিন দিল্লিতে কাটান। ভারতের নিমক তার পেটে তাই কম পড়েনি। পূর্ববর্তী নির্বাচনগুলোর ন্যায় বিগত নির্বাচনেও হাসিনা ভারত থেকে বিপুল অর্থ পেয়েছেন। আর অর্থের সাথে তো শর্তও আসে। ফলে ক্ষমতায় আসার পরই তারা লিপ্ত হয় শর্ত পূরণে তথা ভারতীয় প্রভুর মনোবাসনা পূরণে। হাত দেয় জনগণের ঈমানে। ভারতীয় প্রজেক্টের অংশ রূপেই শেখ মুজিব নাস্তিক কম্যুনিস্টদের দলগড়ার পূর্ণ আজাদী দিলেও সে আজাদী তিনি ইসলামপন্থিদের দেননি। বরং তিনি ইসলামপন্থিদের শত্রুরূপে চিহ্নিত করেছেন। সে নীতি নিয়েই চলেছে শেখ হাসিনা। কিন্তু জনগণ এখন জেগে উঠেছে। জনগণের সে জাগ্রত রূপটি দেখা গেছে ৬ এপ্রিলের লংমার্চ ও সমাবেশে। দেখা গেল ১১ই এপ্রিল ফটিকছড়িতে। ফটিকছড়ির জনগণ সেদিন ছাত্রশিবিরের ডাকা হরতাল স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে হরতাল পালন করছিল। হরতালের মধ্য দিয়েই জনগণ জানিয়ে দেয় সরকারের বিরুদ্ধে তারা কতটা বিক্ষুব্ধ। এটি ছিল তাদের নাগরিক অধিকার। কিন্তু আওয়ামী লীগ জনগণকে সে অধিকার দিতে রাজি নয়। বিরোধী দলকে শান্তি পূর্ণ সমাবেশ করতে দেয়া দূরে থাক তাদেরকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানাতে দিতেও রাজী নয়। জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের তো তারা তাদের দলীয় অফিসে ঢুকতে দিচ্ছে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ও ঢাকা মেট্রোপটিটান পুলিশ কমিশনার তো শিবির কর্মী দেখা মাত্রই গুলির নির্দেশ দিয়েছে। জামায়াত-শিবিরের হাজার হাজার নেতাকর্মীদের কারাবন্দী করা হয়েছে। সেখানে তাদের উপর অমানষিক নির্যাতনও করছে।





যুদ্ধও যখন অপরিহার্য হয়

হরতালে দেশের ক্ষতি হয় তা তো শিশুও বুঝে। সে নসিহত আওয়ামী সরকারের দেয়ার হক আছে কি? দলটি বিএনপির ২০০১-২০০৬ শাসানামলে ১৭৩ দিন হরতাল করেছিল। হরতালের দিনে অফিসগামী মানুষদের তারা উলঙ্গ করেছে। যাত্রী-ভর্তি বাসে আগুন দিয়ে বহু মানুষ হত্যা করেছে। আজ এরাই আবার হরতালের বিরুদ্ধে নসিহত করে! অথচ সে নসিহত কি তারা নিজেরাও মানে? নিজে মানলে গত ৬ এপ্রিলের লংমার্চ ঠেকাতে তারা দুই দিনের হরতাল দিল কেন? সবকিছুই তারা করে নিজেদের রাজনৈতীক স্বার্থে। রাজনৈতীক স্বার্থে তারা যেমন নিজেরা ১৭৩ দিন হরতাল করেছে,তেমনি আবার হরতালের বিরুদ্ধেও কথা বলে।তাছাড়া দেশের অর্থনীতির ক্ষতি কি শুধু হরতালে হয়? সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয় দেশের অর্থনীতির উপর চুরি-ডাকাতিতে। সরকারি দলের লোকদের হাতে দেশের ব্যাংকিং খাতের হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে গেল। ভয়ানক ডাকাতি হয়ে গেল শেয়ার মার্কেটে। হাজার হাজার কোটি টাকা লুন্ঠিত হলো হলমার্ক,ডেস্টিনির মত কোম্পানীগুলোর হাতে। মন্ত্রীদের দূর্নীতির কারণে পদ্মা সেতুর ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে বিশ্ব ব্যাংকের ঋন বন্ধ হয়ে গেল। সরকার কি এসব দুর্নীতিবাজদের একদিনের জন্য শাস্তি দিয়েছে? দেশের অর্থনীতির প্রতি সরকারের সামান্য দরদ থাকলে নিজ দলে এসব চোর-ডাকাতদের কি প্রশ্রয় দিত?



দেশের স্বার্থে এবং ধর্মের প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীনতা বাঁচাতে শুধু বার বার হরতাল নয়,দেশবাসীকে লাগাতর যুদ্ধও করতে হয়।আর যুদ্ধ তো রক্তপাত ঘটবেই। হাজার হাজার মানুষের জানমালের কোরবানীও হয়। অনেক সময় সে কোরবানী অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কারণ দেশের উপর থেকে জালেমের শাসকদের দখলদারি কি শুধু নামায-রোযা,দোয়া-দরুদের কারণে শেষ হয়? এমন মহান বিপ্লবী কাজ তো প্রচুর কোরবানি চায়। আর সে কোরবানীই মু’মিনদের জন্য জান্নাতপ্রাপ্তি নিশ্চিত করে। ইসলামে তাই নামায রোযার পাশাপাশি জিহাদের বিধানও দেয়া হয়েছে। নবীজী (সাঃ)তাই যুদ্ধের পর যুদ্ধ করেছেন। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে,“তোমাদের জন্য যুদ্ধের বিধান দেয়া হলো,যদিও তোমাদের নিকট এটি অপ্রিয়।কিন্তু তোমরা যা অপছন্দ করো সম্ভবত তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর এবং যা ভালবাস সম্ভবত তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আল্লাহ জানেন আর তোমরা জান না।”-(সুরা বাকারা আয়াত ২১৬)।তাই ইসলামের প্রাথমিক যুগে শত্রুর নির্মূল ও মুসলমানদের বিশ্বশক্তি রূপে প্রতিষ্ঠার স্বার্থে বহুরক্ত ও বহুঅর্থ ঢালতে হয়েছে। আবু লাহাব ও আবু জেহেলদের ন্যায় দুর্বৃত্তগণ নিছক দোয়ার বদলে নির্মূল হয়নি। তাদের নির্মূলে নবীজী (সাঃ) ও তার সাহাবায়ে কেরামকে নাঙ্গা তরবারি নিয়ে রণাঙ্গনে দাড়াতে হয়েছে। বহুরক্ত ও বহঅর্থ ব্যয় করতে হয়েছে।



আবু জেহেল আবু লাহাব মারা গেলেও তাদের পৌত্তলিকতা তো আজও বেঁচে আছে। বেঁচে আছে তাদের বিষাক্ত থাবাও। অন্তুত সেটি প্রবল ভাবে বেঁচে শেখ হাসিনার ন্যায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর মগজে। তাই বাংলাদেশের মুসলমানগণ আজ কত্টা বিপদে পড়েছে সেটি কি বুঝতে বাঁকি থাকে? শেখ হাসিনা ২০১১ সালের ৫ই অক্টোবর রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দির ও রামকৃষ্ণ মিশনে দুর্গা পূজা উপলক্ষে পূজামণ্ডপ পরিদর্শনে গিয়ে বলেছেন,“আমরা জানি এবং শুনেছি মা দুর্গা প্রত্যেক বছর কোনো না কোনো বাহন চড়ে আমাদের এ বসুন্ধরায় আসেন। এবার আমাদের দেবী এসেছেন গজে চড়ে। জানি, গজে চড়ে এলে এ পৃথিবী ধন-ধান্যে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে—তা আমরা দেখতেই পাচ্ছি। এবার ফসল ভালো হয়েছে। মানুষ সুখেই-শান্তিতে আছে। দেশের জিডিপি বৃদ্ধি পেয়ে ৭ ভাগে দাঁড়িয়েছে।”-(দৈনিক আমার দেশ,৬ই অক্টোবর, ২০১১)।
 কথা হলো পৌত্তলিক চেতনা তো একাকী বেঁচে থাকে না। সে চেতনার সাথে প্রবল ভাবে বেঁচে থাকে ইসলাম-নির্মূলের চেতনাও।তখন সে পৌত্তলিক চেতনায় ইসলামপন্থিদের রাজনীতি নির্মূলের চেতনা আসবে, ইসলামি নেতাদের ফাঁসিতে ঝুলানোর খায়েশ জাগবে, ইসলামি বিরোধী ব্লগারদের বীর মুক্তিযোদ্ধা বলা হবে –এ সবই কি স্বাভাবিক নয়?





জান্নাত লাভের ব্যবসা

যারা ইসলামের প্রতিষ্ঠা চায় তাদের জন্যও রয়েছে ভাবনার বহু বিষয়। যারা মনে করে নিয়েছে,দেশজুড়ে দু’চার বার হরতাল করলে বা কিছু মিছিল-সমাবেশ করলেই ইসলামবিরোধী শক্তি উৎখাত হবে এবং বাংলাদেশে ইসলামের বিজয় ঘটবে –সে ধারণাটি ভূল। কোন বিপ্লবই এত সহজে হয় না। এটি শয়তানী শক্তির বহুদিনের প্রতিষ্ঠিত শেকড় উপড়ানোর কাজ। কোন একটি গাছের শিকড় উপড়াতেও বহু মেহনত ও ব্হু সময় লাগে। ফলে বাংলাদেশে ইসলামি বিপ্লবের লক্ষ্যে বহুপথ ও বহু কোরবানী এখনও বাঁকি।পরীক্ষার পর পরীক্ষা দিয়ে কীতকার্য হতে হয়। তবে এমন লড়ায়ে মু’মিনের জীবনে সবচেয়ে বড় অর্জনটি রাজনৈতিক বিজয় নয়।সেটি অর্জনটি হলো জীবনের সকল গোনাহ থেকে পরিত্রাণ লাভ,সে সাথে করুণাময় মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে হাশর দিনে মাগফিরাত লাভ। সে মাগফিরাতের পথ ধরেই জুটে জান্নাত লাভ।তবে নিজ ভূমিতে রাজনৈতিক বিজয়ও যে মুমিন মাত্রই পছন্দ করে -সেটিও মহাজ্ঞানী আল্লাহর অজানা নয়।তবে মু’মিন সেটি পায় একটি বোনাস রূপে। আখেরাতের বিশাল অর্জন থেকে এ রাজনৈতিক বিজয়টি এক বাড়তি পাওনা মাত্র। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে এমন একটি রাজনৈতীক বিজয়ের প্রতিশ্রুতিটা এসেছেমাগফিরাত লাভের প্রতিশ্রুতির পরে। তবে এমন একটি বিজয় না পেলেও আখেরাতে ঈমানদারের প্রাপ্তিতে কোন কমতি হয় না। হযরত হামযা (রাঃ)র ন্যায় বহু উচ্চস্তরের সাহাবী সেরূপ বিজয় দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু তাতে কি তারা ব্যর্থ হয়েছেন? তারা তো কাজ করেছেন আখেরাতে পুরস্কার লাভের লক্ষ্যে। এবং সেটি তার বিশাল ভাবেই পাবেন।



কোন কিছুই বিনা মেহনতে জুটে না। সামান্য মুনাফার জন্যও ব্যক্তিকে ব্যবসায় বসতে হয়।সে ব্যবসায় তার মেধা,অর্থ,শ্রম ও সময়ের বিনিয়োগ ঘটাতে হয়। মহান আল্লাহ তাঁর মু’মিন বান্দাহর মহাকল্যাণ চান। সে কল্যাণ পৌঁছাতে তাকে এমন এক ব্যবসার সন্ধান দিতে চান যাতে কোন লোকসান নাই। বরং আছে অতুলনীয় এক বিস্ময়কর মুনাফা। সেটি জান্নাত পাওয়ার মুনাফা। সমগ্র পৃথিবী এবং তার সকল পাহাড়-পর্বত ও সাগর-মহাসাগর যদি সোনা হয়ে যায় এবং কোন ব্যক্তি যদি পৃথিবীময় সে সোনার মালিকও হয়ে যায় তবুও কি তা দিয়ে সে জান্নাতের এক ইঞ্চি ভূমি কিনতে পারবে? পারবে কি সে সম্পদের বিনিময়ে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচতে? মহান আল্লাহপাক সে মহান ব্যবসার সন্ধানটি দিয়েছেন এভাবে,“হে ঈমানদারগণ!তোমাদের কি এমন এক ব্যবসার কথা বলে দিব যা তোমাদেরকে জাহান্নামের কঠিন আযাব থেকে বাঁচাবে? (সেটি হলো) তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর ঈমান আনো এবং তোমাদের জান ও মাল দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করো। যদি তোমরা জানতে,এটিই হলো তোমাদের জন্য কল্যাণকর।(এর বরকতে)আল্লাহ তোমাদের গুনাহ মাফ করে দিবেন এবং এমন এক জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার নিচে দিয়ে ঝরণাধারা প্রবাহিত,আর সে চিরস্থায়ী জান্নাতে তোমাদের জন্য দিবেন উত্তম ঘর। এটি একটি বড় কামিয়াবী।আর অন্যান্য জিনিষ যা তোমরা পছন্দ করো (তাও তোমাদের দেয়া হবে)আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য দিবেন এবং খুব শীঘ্রই দিবেন একটি বিজয়।(হে রাসূল!এ বিষয়ে) মু’মিনদের সুসংবাদ দান করুন।” –(সুরা সাফ আয়াত ১০-১৩)।



উপরুক্ত আয়াতগুলিতে মহান আল্লাহতায়ালার ঘোষণার শিক্ষণীয় মূল বিষয়টি হলো,জাহান্নামের আযাব থেকে মুক্তি লাভ,হাশর দিনে মাগফেরাত লাভ ও পরকালে জান্নাত লাভ এবং দুনিয়ার বুকে রাজনৈতীক বিজয় লাভের জন্য ঈমানদারের জীবনেও লাগাতর একটি ব্যবসা চাই। সে ব্যবসায়ে জানমালের বিনিয়োগ চাই। মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশিত সে ব্যবসাটি হলো জিহাদ। মুসলমান হওয়ার অর্থ তাই শুধু কালেমা পাঠ নয়। স্রেফ নামায-রোযা,হজ-যাকাত পালনও নয়।বরং মহান আল্লাহর নির্দেশিত এ ব্যবসাকে তথা জিহাদকে জীবনের মূল ব্যবসা রূপে গ্রহণ করা। স্রেফ নামায-রোযা,হজ-যাকাত ও অন্যান্য ইবাদত মূলত মূল ব্যবসায়ে তথা জিহাদে ব্যক্তিকে আধ্যাত্মীক ভাবে প্রস্তুত করে।সে প্রস্তুতি না আসলে বুঝতে হবে তার ইবাদতেই সমস্যা আছে। প্রতিটি সাহাবায়ে কেরামের জীবনে মূল ব্যবসা ছিল জিহাদ। নানা পেশায় তাঁরাও কাজকর্ম করেছেন,তবে সে পেশাগুলো তাদের জীবনের মূল লক্ষ্য ছিল না। সেগুলি ছিল নিছক জীবন নির্বাহের কৌশল। মূল লক্ষটি ছিল আল্লাহগর দ্বীন প্রতিষ্ঠা ও ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার জিহাদ। এবং সে জিহাদের মাধ্যমে আখেরাতে মাগফেরাত লাভ ও জান্নাত লাভ।



ক্ষতির ব্যবসা

মানুষের সকল ব্যবসা ও সকল বিনিয়োগ শুধু ক্ষতির অংকই বাড়ায় যদি তা ইসলামের পথে না হয়। সে সত্যটি পবিত্র কোরআনের সুরা আসরে বলা হয়েছে এভাবে,“সময়ের কসম, নিশ্চয়ই সকল মানুষই ক্ষতির মধ্যে। একমাত্র তারা ব্যতীত যার ঈমান এনেছে,নেক আমল করেছে এবং একে অপরকে সৎ কাজের নসিহত করেছে এবং সবর ধারণ করেছে।” আর সবচেয়ে বড় নেক আমল হলো কাউকে অর্থদান, খাদ্যদান বা পথ থেকে কাটা সরানো নয়। বরং সেটি হলো সমাজ ও রাষ্ট্রের বুক থেকে তাগুতী তথা শয়তানি শক্তির দখলদারি সরানোর কাজ। ঘন মেঘ যেন সূর্যকে আড়াল করে রাখে কোরআনের সত্যকেও তেমনি আড়াল করে রাখে শয়তানি শক্তির হুকুমত। এভাবে তারা জাহিলিয়াত যুগের অন্ধকার নামিয়ে আনে। বাংলাদেশে আজ সেকাজটিই ব্যাপাক ভাবে হচ্ছে। জাহিলিয়াত যুগে মানুষ আল্লাহর ঘরে মুর্তি বসিয়েছিল। আর আজ বাংলাদেশে মুর্তি বসানো আছে নানাস্থানে। সেগুলিতে শ্রদ্ধা জানাতে ফুল চড়ানো হচ্ছে।



মহান আল্লাহতায়ালা যেমন ব্যক্তির ঈমান ও ইবাদত-বন্দেগী দেখেন,তেমনি তার প্রদর্শিত ব্যবসায় জান ও মালের বিনিয়োগও দেখেন। আল্লাহর অবাধ্যতা তথা কুফরি হয় যেমন তাঁর নির্দেশিত নামায-রোযা ও হজ-যাকাতের ন্যায় ইবাদত পালন না করায়,তেমনি অবাধ্যতা ঘটে যখন আল্লাহর নির্দেশিত ব্যবসায় জানমালের বিনিয়োগ করা না হয়। আজকের মুসলমানদের দ্বারা বড় অবাধ্যতা হচ্ছে তো এ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে। তাদের সমুদয় সময়,শ্রম ও মেধা নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে তাদের পেশাগত সাফল্য অর্জনে।নিজেদের পেশাগত সাফল্যে আনন্দ চিত্তে ভাবছে তারা ভালই করছে। অথচ এমন পেশাগত সাফল্যের বড়াই তাদের জাহান্নামে নিয়ে পৌছাবে।পবিত্র কোরআনে তাদের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বলা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহর সে ঘোষণাটি এসেছে এভাবে,“(হে মুহাম্মদ তাদেরকে) বল, আমি কি তোমাদের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের খবর শুনাবো? (তারা হচ্ছে) সে সব ব্যক্তি যারা জীবনের সকল প্রচেষ্টা শুধু পার্থিব জীবনের জন্য নিয়োজিত করে এবং তারা ভাবে কর্মে তথা পেশাগত ভাবে তারা কতই না উত্তম কাজ করছে।”-(সুরা কাহাফ,আয়াত ১০৩-১০৪)।



তাই সামান্য কয়েক দিনের হরতাল পালনে মুসলমানের জিহাদ শেষ হবে সেটি কি আশা করা যায়? তাছাড়া এ জিহাদ তো কি শুধু হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে? হাসিনা ও তার ১৪দলীয় মিত্রবাহিনীর লোকেরা তো এ যুদ্ধে নিছক ফুটসোলজার মাত্র। এ যুদ্ধের আসলে জেনারেলগণ তো যুদ্ধ লড়ছে দিল্লিতে বসে। যেমনটি লড়েছিল ১৯৭১য়ে। ভারত হাসিনার ঘাড়ে বন্দুক রেখে মূল শত্রু ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধে আঘাত হানছে মাত্র। ফলে হাসিনা গদি উল্টে গেলে ভারত অন্যদের ঘাড়ে বন্দুক রাখবে। মুজিবের মৃত্যুর পরা তারা খালেদ মোশাররফকে বেছে নিয়েছিল। অতীতে জেনারেল এরশাদ ও জেনারেল মঈনকেও ভারত ব্যবহার করেছে।ভবিষ্যতে অন্যদেরও বেছে নিবে। তাছাড়া এমন বিশ্বাসঘাতক উৎপাদনে বাংলাদেশের ভূমি কি এতটাই অনুর্বর?



জিহাদেই শক্তি

কোন দেশে যুদ্ধ শুরুর মধ্যে যেমন নানা দুঃসংবাদ থাকে তেমনি প্রচণ্ড একটি সুংবাদও থাকে। কারণ যুদ্ধ জাতির জীবনে একটি প্রসব বেদনা। যুদ্ধই মানব ইতিহাসে বড় বড় বিপ্লব প্রসব করেছে। নির্মাণ করেছে বড় বড় সভ্যতা। যুদ্ধের মধ্য দিয়েই জাতির জীবনে জন্ম নেয় সাহসী মোজাহিদের। নির্মূল হয় রাজনৈতীক ও সামাজিক জঞ্জাল। পরিবর্তন আসে রাজনৈতিক ও আদর্শিক মানচিত্রে। তাই যুদ্ধ সব জাতিকে দুর্বল করে না। বহু জাতিকে শক্তিশালীও করে। অফুরন্ত শক্তি ও প্রাণের সঞ্চারও করে। যুদ্ধের পর যুদ্ধ করেই প্রাথমিক কালের মুসলমানগণ বিশ্বশক্তি রূপে আবির্ভুত হয়েছিলেন।পরাজয় তো তখনই শুরু হয়েছে যখন মুসলমানগণ যুদ্ধে আগ্রহ হারিয়েছে। তাছাড়া যুদ্ধ তো জান্নাত লাভের চাবি। এখানেই তো মু’মিনের মূল পরীক্ষাটি হয়। পবিত্র কোরআনের মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাই ঘোষণা করেছেন,“তোমরা কি মনে করে নিয়েছো যে এমনিতেই জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ এখনও তোমাদের উপর তোমাদের পূর্ববর্তীদের ন্যায় অবস্থা আসে নাই। তাদেরকে আক্রান্ত করেছিল অর্থ-সংকট,দুঃখকষ্ট;(ঈমানের সে পরীক্ষায়)তারা ভীত এবং প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল।এমন কি রাসূল এবং তাঁর সাথে যারা ঈমান এনেছিল তাঁরা বলে উঠেছিলেন,“আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে?” জেনে রাখো,অবশ্যই আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটে।”-(সুরা বাকারা,আয়াত ২১৪)। আরো বলা হয়েছেঃ “তোমরা কি মনে করে নিয়েছো যে তোমরা এমনিতেই জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ তোমাদের মধ্যে কে জিহাদ করেছে আর কে ধৈর্যশীল আল্লাহ সেটি এখনও প্রকাশ করেননি।”–(সুরা আল ইমরান, অয়াত ১৪২)। একই চেতনা ব্যক্ত হয়েছে নবী-জীবনের জিহাদে ও জিহাদ বিষয়ক তাঁর অসংখ্য হাদীসের মধ্য দিয়ে। এক্ষেত্রে সহীহ মুসলিম শরিফের প্রসিদ্ধ হাদীসঃ “যে ব্যক্তি মৃত্যূবরণ করলো অথচ জিহাদ করলো না এবং জীবনে জিহাদে যোগ দেয়ার বাসনাও করলো না সে ব্যক্তির মৃত্যু হলো মুনাফিক রূপে।” মহান আল্লাহতায়ালা আরো বলেছেন,“মানুষ কি মনে করে যে,“আমরা ঈমান এনেছি” শুধু এটুকু বললেই তাদের ছেড়ে দেয়া হবে,আর তাদের পরীক্ষা করা হবে না? অথচ তাদের আগে যারা ছিল তাদের সবাইকে আমি পরীক্ষা করেছি।আল্লাহকে তো অবশ্যই দেখে নিতে হবে, (ঈমান এনেছি বলার মধ্যে)কে সত্যবাদী,আর কে মিথ্যুক।”–(সুরা আনকাবুত আয়াত ২-৩)।



উপরুক্ত আয়াতগুলিতে যা বলা হয়েছে পবিত্র কোরআনে জিহাদ বিষয়ক এমন নির্দেশাবলী বহু। মহান রাব্বুল আলামীন তাঁর প্রতিটি মু’মিন বান্দাহকে জান্নাতের নিয়ামত ভরা জীবনের পুরস্কার দিতে চান। তবে সেটি কীরূপে সম্ভব -জান্নাতের সে চাবিটি তিনি কোন গোপন স্থানে রাখেননি। বরং পবিত্র কোরআনে সে চাবীর সন্ধান দিয়েছেন বার বার। সে চাবীটি যে আল্লাহর পথে জিহাদে সে বিষয়টি তিনি নানা ভাবে সুস্পষ্ট করেছেন।সাহাবায়ে কেরামের ন্যায় প্রতি যুগের প্রকৃত ঈমানদারগণ সে চাবীকে চিনতে ভূল করেননি,ভূল করনেনি শক্ত হাতে তা আঁকড়ে ধরতেও। নবীজীর প্রত্যেক সাহাবা তো সে চাবি নিয়ে জেহাদ করেছেন এবং অধিকাংশ সাহাবা শহীদও হয়েছেন।ফলে তারা জান্নাতের সুখবরও পেয়েছেন।তাদের সম্পর্কেই তো মহান আল্লাহতায়ালা বলেছেন,“তাদের উপর আল্লাহ রাজী আছেন এবং তারা রাজী আছেন আল্লাহর উপর” –(সুরা বাইয়েনাহ)। মহান আল্লাহর প্রদর্শিত ব্যবসায় জানমালের সর্বোচ্চ বিনিয়োগের কারণে তারাই সমগ্র মানব ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব।মুসলমানগণ শুধু মুখে ঈমান এনেছি বলবে,নামায-রোযা ও হজ-যাকাত পালন করবে,আর তাতেই পরকালে তারা জান্নাত পাবে -তেমন সহজ পথ যে আল্লাহতায়ালা খোলা রাখেননি উপরের আয়াতগুলোতে কি সেটাই প্রকাশ পায় না? নবীজী (সাঃ)র সাহাবাগণ এ বিষয়টি শতভাগ বুঝেছিলেন। ফলে সে আমলে এমন কোন সাহাবা ছিলেন না যারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেননি। তাদের কাছে সে জিহাদটি ছিল ইসলামের বিজয়,রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা,শরিয়তের প্রতিষ্ঠা ও সে লক্ষ্যে জালেম শক্তির নির্মূলে জানমালের সর্বাত্মক বিনিয়োগ।



বাংলাদেশীদের সৌভাগ্য

কোন দেশে জিহাদ শুরু হলে বুঝতে হবে আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে সেখানে মু’মিনদের চুড়ান্ত পরীক্ষাটিও শুরু হয়ে গেছে। আর এমন পরীক্ষা শুরু হওয়াটাই যে কোন ঈমানদারের জন্য বড় সুংবাদ। কারণ প্রতিটি পরীক্ষাই অংশগ্রহণকারীদের জন্য বড় রকমের প্রমোশনের সুযোগ নিয়ে আসে।তবে সে প্রমোশনের জন্য তাকে সে পরীক্ষায় পাশ করতে হয়। আর তাছাড়া পরীক্ষায় বসার জন্যও তো যোগ্যতা লাগে। বিবেকশূণ্য গরুছাগলদের তো পরীক্ষায় হলে বসানো যায় না! ফলে যে দেশে জিহাদ নাই,বুঝতে হবে সে দেশের জনগণ মহান রাব্বুল আলমীনের দরবারে প্রমোশন পাওয়ার জন্য যোগ্য বিবেচিত হয়নি। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার যে ইসলামের বিপক্ষ শক্তির সরকার তা নিয়ে কি সন্দেহ আছে? শরিয়তি আইনের প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে এই সরকার।সরকারি মন্ত্রীগণ বলছে,শরিয়তী আইন প্রতিষ্ঠা পেলে বাংলাদেশে মধ্যযুগীয় অন্ধকার নেমে আসবে। এরূপ বক্তব্যের পর মহান আল্লাহতায়ালা,তাঁর মহান রাসূল (সাঃ) ও কোরআন-সূন্নাহর দুষমণ প্রমাণিত হওয়ার জন্য কি অন্য কোন দলীল লাগে? কাশ্মীর,মায়ানমার ও ভারতের মজলুম মুসলমানদের পক্ষ না নিয়ে হাসিনা সরকার ও তার ১৪ দলীয় জোট ভারতের শাসক শক্তির মিত্র হওয়াকেই অধীক গুরুত্ব দেয়। সরকারি টিভি ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের মালিকানাধীন পত্র-পত্রিকা ও টিভিতে দাড়ি-টুপিধারিদের চরিত্র হরণ হচ্ছে লাগাতার।
এমন একটি ইসলাম বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে মুসলিম ভূমিতে জিহাদ খাকবে না সেটি কি ভাবা যায়?

Sunday, April 21, 2013

‘নারী নীতি’ নিয়ে বিভ্রান্তি


‘নারী নীতি’ নিয়ে বিভ্রান্তি

ফরিদা আখতার
Friday 19 April 13





এক

হেফাজতে ইসলাম এপ্রিলের ৬ তারিখে ঢাকা শহরে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় একটি শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করে প্রশাসনের সঙ্গে ওয়াদা অনুযায়ী ঠিক ঠিক পাঁচটার সময় শেষ করে ফিরে গেছেন। ঢাকা শহরের মানুষ শাপলা চত্বরে এতো আলেম ওলামাদের একসাথে কখনো দেখে নি, তারা বিস্মিত। কত মানুষ জড়ো হয়েছিলেন তা নিয়ে সঠিকভাবে কোন পরিসংখ্যান না পাওয়া গেলেও সংখ্যাটা তাক লাগিয়ে দেয়ার মতোই ছিল। হেফাজতের এই লং মার্চ যেন না হতে পারে তার জন্য সরকার নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল; ঢাকাগামী সকল প্রকার যানবাহন বন্ধ করার পরও এতো মানুষ কি করে ঢাকায় এলো তা বিস্ময়ের ব্যাপার বটে।

হেফাজতের এই কর্মসুচী শেষ হয়েছে, তাঁরা নিজ নিজ এলাকায় ফিরেও গেছেন, কিন্তু শেষ হয় নি তাঁদের নিয়ে আলোচনা বা সমালোচনা। তবে টেলিভিশনের টকশোগুলোর ধরণ পালটে গেছে। প্রায় প্রতিটি চ্যানেলে একজন হেফাজতের মুফতি আসছেন তাঁদের ১৩ দফা দাবীর ব্যাখ্যা দিতে, কিংবা একই মুফতিকে এক চ্যানেল থেকে অন্য চ্যানেলে দৌড়াতে হচ্ছে অতিথি হয়ে।

হেফাজতের তেরো দফা বোঝা এবং বোঝানোর দরকার আছে। সেই দিক থেকে হেফাজতে ইসলামের পক্ষে গণমাধ্যমে মুফতিদের এই উপস্থিতি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। চ্যানেলগুলোর পক্ষ থেকে তাঁদের ডাকা হচ্ছে শুধু ১৩ দফা বোঝার বা বোঝানোর জন্য ভাবলে ভুল হবে। বরং অধিকাংশ সময় ডাকা হচ্ছে তাঁদের একটু হেনস্থা বা বেকায়দায় ফেলার জন্যে। তাঁরা যে চিন্তাচেতনায় সমাজের পশ্চাতপদ মানুষ এটা যে কোন ভাবে প্রমাণ করা অনেক গণমাধ্যমের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একজন আলেমকে ঘায়েল করার জন্য থাকছেন তিন চারজন বুদ্ধিজীবী, নারী নেত্রী এবং রাজনীতিবিদ। দর্শকরা উপভোগ করছেন এই আলোচনা। টক শো যেন একটি খেলা। শো-এর পর দর্শকরা কে জিতলো, কে হারলো, এই তর্কে মাতে। নিজ নিজ অবস্থান অনুযায়ী খুশী বা অখুশী হয় অনেকে।

তের দফা দাবী না মানলে কঠোর কর্মসুচীর ঘোষণা দিয়েছেন হেফাজতে ইসলাম। তের দফার দুটো দফাতেই নারীদের কথা আছে। হেফাজত নারীদের মধ্যযুগে ঠেলে দিচ্ছে বলে হায় হায় শুরু হয়ে গেছে অনেকের মধ্যে, বিশেষ করে যাঁরা নিজেদের ‘প্রগতিশীল’ মনে করেন, তাঁরা দুঃশ্চিন্তায় পড়েছেন।

এর মধ্যে সাধারণ মানুষ একটু বিভ্রান্ত হচ্ছেন। এই ঘটনা এ্মন এক সময় ঘটলো যখন একদিকে বিরোধী দলের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার আন্দোলন চলছে, তাদের নেতা কর্মীরা জেলে; অন্যদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও রায় নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন গরম হয়ে আছে। একই সময় শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ নতুন মাত্রা যোগ করে দেশকে একেবারে তরমুজের মতো করে দুইভাগ করে ফেলেছে। কতিপয় ব্লগারের মহানবী (সঃ)কে নিয়ে ভয়াবহ কটুক্তি করেছে। তাদের এই নাস্তিকতার বিরুদ্ধে হেফাজতে ইসলাম সক্রিয় হয়ে ওঠে। যে কেউ নাস্তিক হতে পারে কিন্তু অন্যের বিশ্বাস, ধর্ম বা তাদের ধর্মের প্রিয় মানুষদের বিরুদ্ধে কুৎসিত ও কদর্য ভাবে লেখালেখি করতে পারে না।

আমি যতদুর জানি, হেফাজতে ইসলাম জামায়াতে ইসলামীর বিপক্ষে। তারা যুদ্ধাপরাধের বিচার চাইছে, কিন্তু গণজাগরণ মঞ্চকেও তারা গ্রহণ করতে পারছেন না। হেফাজতে ইসলাম ‘নাস্তিক’ ব্লগারদের, বিশেষ করে যারা ধর্মের ও রাসুলেরও অবমাননা করেছে, তাদের শাস্তির দাবী নিয়ে এসেছে। শাহবাগ শুরু হয়েছিল যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি নিয়ে। কিন্তু এই একটি দাবীর পর এখন জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করা,এরপর দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করা,শেষে মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করা সহ শাহবাগের ছয় দফা নানাদিকে বিস্তারিত হয়েছে। হেফাজতে ইসলামও ব্লগারদের শাস্তির দাবী থেকে এখন নিয়ে এসেছে ১৩ দফা। তের দফার সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে মাহমুদুর রহমানের মুক্তি দাবী।

দুই

শাহবাগের ৬ দফা নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয় না, কারণ ধরে নেয়া হয়েছে এই সব দাবী নিয়ে কোন বিতর্ক নাই। সরকারের মেনে নেয়ার ব্যাপার মাত্র। যা সরকার একের পর এক তাদের জন্য করে যাচ্ছে। যদিও ছয় দফা নিয়েও বিতর্ক হতে পারে। আমি হেফাজতের ১৩ দফা নিয়েই লিখছি, কিন্তু সব দফা নিয়ে নয়। শুধু নারী অধিকারের প্রশ্নের সাথে জড়িত দুটি দাবীর (দাবী নং ৪ ও ৫) বিষয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন মনে করছি।

হেফাজতে ইসলামের দাবীগুলোর ঢালাও বিরোধিতা করার কারণ আমি দেখি না। ব্যাপারটা বিরোধিতা বা পক্ষে দাঁড়িয়ে যাবার বিষয় নয়। গ্রামীণ গণ মানুষের বিশাল একটি অংশের ক্ষোভ-বিক্ষোভের জায়গাগুলো নারী সমাজের বোঝা দরকার। তারা তাদের ক্ষোভ বিক্ষোভের কথাগুলো জানিয়েছে। এখন দরকার সেগুলো নিয়ে সমাজের অন্যান্য অংশের সাথে একটা ব্যাপক আলোচনার আয়োজন করা। সেদিক থেকে নারী আন্দোলনের কর্মী হিশাবে যে সকল দাবি নারীর জন্য প্রাসঙ্গিক আমি শুধু সেই দাবিগুলো নিয়ে কিছু কথা তুলব। কিন্তু আমার ভয় হয় এই ডায়লগ, ব্যাপক কথাবার্তা বা আলোচনার জন্য যে সময় প্রয়োজন তা আমরা দিতে চাই কি না। একটি পক্ষ মনে করে দাবী আদায়ের সময় নির্ধারণ করে দিয়ে কোন প্রকার আলোচনা ছাড়াই বলপ্রয়োগে সমাধান করতে হবে। অন্যদিকে এই দাবিগুলো ধর্মের মোড়কে ইসলামপন্থিদের পক্ষ থেকে তোলা হয়েছে বলেই নারীদের প্রথম প্রতিক্রিয়াই নেতিবাচক হয়ে গেছে। কিন্তু চোখ বন্ধ করে এর বিরোধী হতে হবে, এটাও কোন যুক্তি হতে পারে না। যে মোড়কেই আসুক মোড়ক খুলে মুল বিষয় নিয়ে আমাদের পরস্পর কথা বলতেই হবে। এখন সে সময় এসেছে। ধর্মের পুরুষতান্ত্রিক নির্যাতন নতুন কোন গল্প নয় যে নারীদের তা বোঝাতে হবে। সেটা করতে গিয়ে নারীকে কে ধর্মের বিপরীতে দাঁড় করানোর বিপদও আমাদের ভেবে দেখতে হবে। বেগম রোকেয়া তা অনেক আগেই এইসব বুঝিয়ে গেছেন। কিন্তু মুশকিল হয় যখন এই নির্যাতনের বিরুদ্ধে নারী মুক্তির নামে দাঁড়াতে গিয়ে আমরা পুরুষতান্ত্রিক অবাধ বাজারব্যবস্থা ও নারীকে পণ্যে রূপান্তরের পক্ষে দাঁড়িয়ে যাই। আবার ধর্মীয় জায়গা থেকে তোলা দাবিদাওয়া বলে এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া রাবারের মতো ক্রমাগত টানতে গিয়ে জেনে বা না জেনে বাংলাদেশকে আরও ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে থাকি।

ধর্মের পুরুষতান্ত্রিক নির্যাতন নতুন কোন গল্প নয় যে নারীদের তা বোঝাতে হবে। সেটা করতে গিয়ে নারীকে কে ধর্মের বিপরীতে দাঁড় করানোর বিপদও আমাদের ভেবে দেখতে হবে। বেগম রোকেয়া তা অনেক আগেই এইসব বুঝিয়ে গেছেন। কিন্তু মুশকিল হয় যখন এই নির্যাতনের বিরুদ্ধে নারী মুক্তির নামে দাঁড়াতে গিয়ে আমরা পুরুষতান্ত্রিক অবাধ বাজারব্যবস্থা ও নারীকে পণ্যে রূপান্তরের পক্ষে দাঁড়িয়ে যাই। আবার ধর্মীয় জায়গা থেকে তোলা দাবিদাওয়া বলে এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া রাবারের মতো ক্রমাগত টানতে গিয়ে জেনে বা না জেনে বাংলাদেশকে আরও ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে থাকি।

ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দল, নারী সংগঠন ও সামাজিক সংগঠনের কাছ থেকে অনেক প্রতিক্রিয়া এসেছে। তাদের একটি সাধারণ বক্তব্য হচ্ছে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা মানলে আমরা মধ্যযুগে ফিরে যাবো। কেমন করে? সেটা কিন্তু কেউ পরিস্কার বলছেন না। প্রথমত মধ্যযুগ বর্তমান যুগের চেয়ে মন্দ ছিল কিনা সেটা একটা তর্কের বিষয়। দ্বিতীয়ত কেউ মধ্যযুগে যেতে চাইলেই কি যেতে পারবেন? আমার মনে হয় না। তৃতীয়ত আমরা একটি বিশ্বব্যবস্থার মধ্যে বাস করছি, হেফাজতে ইসলাম বা আমরা কেউই এর বাইরে নই। ফলে হেফাজতে ইসলাম বিশ্বব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত আমাদের কোন এক ‘মধ্যযুগে’ ফিরিয়ে নিতে পারবে এমন কোন সম্ভাবনা দেখছি না। বরং সমাজের গণমানুষের বিশাল একটি অংশ বিদ্যমান ব্যবস্থাকে কিভাবে দেখছে, কিভাবে সমালোচনা করছে এবং কিভাবে তার প্রতিকার খুঁজছে সেটা বুঝতে পারাই আমাদের প্রধান কাজ হতে পারে। আমাদের দরকার ধর্মীয় ভাষায় তোলা তাদের মুল বক্তব্য গুলো একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কতটুকু বাস্তবায়ন সম্ভব, এবং কতটুকু অসম্ভব বা কেন সম্ভব নয় ইত্যাদি বিষয় নিয়ে একটা সুস্থ আলোচনার দিকে নেয়া্র চেষ্টা করা। তাদের দাবিগুলো আদৌ সমর্থন করা যাবে কিনা, কিম্বা কতোটুকু করা যাবে তার তর্কবিতর্ক কিভাবে হতে পারে সেইসব আলোচনা করা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারাই গ্রামের গরীব নারী-পুরুষদের কাছে একটি প্লাটফর্ম হিসেবে হাজির হতে পেরেছে। কাজেই একে উপেক্ষা করা আমাদের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আমি ধন্যবাদ জানাই হেফাজতে ইসলামকে। কারণ প্রথম ১৩ দফা হাজির করার পর সমাজের প্রতিক্রিয়ায় তাঁরা সাড়া দিচ্ছেন। তারা পত্রিকায় তের দফার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সেই ব্যখ্যা থেকেও আমি দফা ৪ ও ৫ নিয়ে কিছু বিশ্লেষণ করতে চাই।

দফা নং ৪.ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার,ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বালনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা।

এই দাবীকে ভাগ করলে অন্তত তিনটি ভিন্ন দাবী তৈরী করা যেতো। যেমন ১. ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতা, ২. বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ এবং ৩. মোমবাতি প্রজ্বলনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ।

অর্থাৎ এই ৪ নং দাবীটি পুরোটাই নারীদের বিরুদ্ধে নয়। মোমবাতি প্রজ্বালনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশের অংশটি বাদ দিলে থাকে “বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ” অংশটি। এবং এই অংশটি নিয়েই চলছে বিতর্ক। আমার মনে হয় এই অংশটি হেফাজত বা কোন ইসলামী দলের কাছ থেকে না এসে যদি কোন রাজনৈতিক দল, কিংবা নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আসতো,আমরা একে স্বাগতই জানাতাম হয়ত। পুঁজিতান্ত্রিক ও পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অনেক নারী এই ধরণের সমস্যার শিকার হচ্ছেন, যা নারীকে পণ্য আকারে হাজির করছে। কেউ কেউ হয়তো স্বেচ্ছায় এমন পথ বেছে নিয়েছেন, কিন্তু তাদের কারণে অধিকাংশ নারীদের ওপর অপবাদ আসছে। ফলে এই অবস্থা পরিবর্তন করা প্রগতিশীল নারীদেরও দাবী হতে পারে,এবং হয়েছেও। এর সাথে নারীদের ঘর থেকে বের হবার বা না হবার কোন সম্পর্ক নেই। হেফাজতে ইসলামের এই দাবী থেকে অনেকে ভেবে নিয়েছেন তাঁরা নারীদের ঘর থেকেই বের হতে দিতে চান না। নারীদের কাজ করা বা শিক্ষার সুযোগ একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে। দেখা যাক, আল্লামা আহমদ শফি এই নিয়ে কী ব্যাখ্যা দিচ্ছেনঃ

“দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য নারীজাতির সার্বিক উন্নতির বিকল্পনেই। এ লক্ষ্যে তাদের নিরাপদ পরিবেশে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মস্থল,সম্মানজনক জীবিকা এবং কর্মজীবী নারীদের ন্যায্য পারিশ্রমিকেরব্যবস্থা করতে হবে। ঘরে-বাইরে, কর্মস্থলে নারীদের ইজ্জত-আব্রু, যৌনহয়রানি থেকে বেঁচে থাকার সহায়ক হিসেবে পোশাক ও বেশভূষায়শালীনতা প্রকাশ এবং হিজাব পালনে উদ্বুব্ধকরণসহ সার্বিক নিরাপত্তানিশ্চিত করতে হবে; এবং একই লক্ষ্যে নারী-পুরুষের সব ধরনেরবেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে অবাধ ও অশালীন মেলামেশা,নারী নির্যাতন, যৌন হয়রানি, নারীর বিরুদ্ধে সর্বপ্রকার সহিংসতা,যৌতুক প্রথাসহ যাবতীয় নারী নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা কঠোর হাতে দমনকরতে হবে”।

এই ব্যাখ্যায় আমি মৌলিকভাবে কোন সমস্যা দেখি না। তবে শুধু এটা যেন না হয় যে শালীনতার একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞা থাকবে, তার বাইরে অন্য পোষাক থাকবে না। ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের কিছু বিষয় হেফাজতে ইসলাম তুলে এনেছে, যা আমি এখানে উল্লেখ করলাম না। এ অভিযোগ সত্যি কিনা প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, কিন্তু বিক্ষিপ্তভাবে কিছুটাও যদি সত্যি হয় তাহলে এমন প্রতিক্রিয়া আমরা ঠেকাতে পারবো না। আমরা কেউই কোন নারী-পুরুষের দৃষ্টিকটু বিচরণ চাই না, এমনকি উন্নত বিশ্বেও চায় না। এটা যার যার ব্যক্তিগত রুচির প্রশ্ন নয়, কারণ যে কোন সমাজে রুচির প্রশ্নেও একটা সামাজিক মানদণ্ড গড়ে ওঠে। সামাজিক মানদণ্ড নিপীড়নমূলক হলে মেয়েরা অবশ্যই আপত্তি করবে। ব্যক্তি ও সমষ্টির মধ্যে একটা ভারসাম্য রক্ষা করেই সামাজিকতা গড়ে ওঠে। শাহবাগ নিয়ে অন্য প্রশ্ন তোলা হলেও যে সব নারী সামনের কাতারে আছে তাঁদের পোষাক নিয়ে আপত্তি তোলার কোন জায়গা আমি দেখি না। আল্লামা আহমদ শফি বলছেনঃ “আমাদের কথা পরিষ্কার যে, হিজাব বা শালীনতার সঙ্গে নারীদের নিরাপদপথ চলাচল, শিক্ষার্জন ও কর্মক্ষেত্রে যেতে কোনো বাধা নেই।”

তাঁদের আর একটি বক্তব্য ‘নারীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য আলাদাবালিকা বিদ্যালয় বা মহিলা কলেজ থাকতে পারলে আলাদা কর্মক্ষেত্রপ্রতিষ্ঠার দাবিতে আপত্তি তোলার যুক্তি থাকতে পারে না’’ । এই দাবী কতখানি বাস্তব সম্মত হবে তা ভেবে দেখার বিষয়। আমরা নিজেরাও মনে করি প্রতিটি কর্মস্থলে নারীদের প্রয়োজনে কিছু আলাদা ব্যবস্থা অবশ্যই থাকতে হবে। বেশির ভাগ কর্মস্থল নারীকর্মীদের উপযোগী করা নয়। এবং সেটা হলে নারীরা কাজ করতে অনেক স্বাচ্ছন্দ বোধ করবেন। কিন্তু আলাদা কর্মস্থল সম্ভব হবে কিনা সেটা আমরা তাদের বিবেচনা করতে বলতে পারি।

আমরা কেউই কোন নারী-পুরুষের দৃষ্টিকটু বিচরণ চাই না, এমনকি উন্নত বিশ্বেও চায় না। এটা যার যার ব্যক্তিগত রুচির প্রশ্ন নয়, কারণ যে কোন সমাজে রুচির প্রশ্নেও একটা সামাজিক মানদণ্ড গড়ে ওঠে। সামাজিক মানদণ্ড নিপীড়নমূলক হলে মেয়েরা অবশ্যই আপত্তি করবে। ব্যক্তি ও সমষ্টির মধ্যে একটা ভারসাম্য রক্ষা করেই সামাজিকতা গড়ে ওঠে। শাহবাগ নিয়ে অন্য প্রশ্ন তোলা হলেও যে সব নারী সামনের কাতারে আছে তাঁদের পোষাক নিয়ে আপত্তি তোলার কোন জায়গা আমি দেখি না।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, চার নম্বর দাবীতে নারীদের ঘরে ঢোকানো হচ্ছে না, বরং নারীদের সুরক্ষার কথা বলা হচ্ছে ইসলামের বয়ানে। এই প্রস্তাবে ভীত না হয়ে আমাদের দেখতে হবে নারীদের বর্তমান অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রেখে নারীকে ভোগ্য পণ্য ভেবে যারা নির্যাতন করে, তাদের হাত থেকে আমরা কিভাবে মুক্ত হতে পারি। আমাদের সমস্যা হচ্ছে কেউ ধর্মের নামে নীতির কথা বললে ঘাবড়ে যাই যে তাহলে বুঝি ধর্মীয় গোঁড়ামীর মধ্যে পড়ে গেলাম। ‘বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার’, কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য নয়, তবে প্রতিটি সংস্কৃতি ও সামষ্টিক মূল্যবোধ সামাজিক ভাবেই এই সকল বিষয় নির্ধারণ করে। আমি আল্লামা আহমদ শফি এবং হেফাজতে ইসলামের অন্যান্য নেতা ও কর্মীদের অনুরোধ করবো এই বিষয়টি নারীর অধিকার ও সামাজিক মর্যাদা রক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হোক, কোন আরোপিত নীতি হিশেবে নয়। শাসনের সুরে নয়। সমাজকে নৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে আরও বিকশিত করে নেবার দায়িত্ব আছে সকলেরই। সেই দিক থেকে আলোচনা করলে তা ইতিবাচক হবে। বিশ্বের অনেক দেশেই এখন নারীরা কাজ করছেন। মুসলিম নারীরা হিজাব পরে কিংবা না পরেও শালীনভাবে কাজে যাচ্ছেন এবং নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করছেন। তবে মনে রাখতে হবে, এ কথা কেউ হলফ করে এখনও বলতে পারবে না যে নারীর পোষাক পরিবর্তন হলে আপনা থেকেই ধর্ষণ বা যৌন হয়রানী বন্ধ হয়ে যাবে। এই বিষয়টির সাথে পুরুষদের মন মানসিকতা ও নারীর প্রতি ব্যক্তি ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী জড়িত। এটা যতোদিন সামাজিক আন্দোলন করে নৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে পরিবর্তন না করা যাবে ততদিন এই দুরাবস্থা চলতে থাকবে। তাছাড়া শালীনতা শুধু মেয়েদের বিষয় হতে পারে না। একই সঙ্গে পুরুষদের শালীন ও সংস্কৃতিবান হতে হবে। কিন্তু সেই দাবি হেফাজতে ইসলাম করে নি।

হেফাজতের সমাবেশে আসা নারী সাংবাদিকের ওপর আক্রমণ দিয়ে অন্তত এটা মনে হয় যে নারীরা আশে পাশে থাকলেই পুরুষরা তাদের আলাদা দৃষ্টিতে দেখেন। এবং সেটা ক্ষেত্র বিশেষে ধর্ষণে গিয়ে পর্যবসিত হয়। নাদিয়ার শারমিনের ক্ষেত্রে সৌভাগ্যক্রমে সেটা হয় নি, তবে তিনি অনেক বেশী আঘাত পেয়েছেন। এটাও শারীরিক আক্রমণ তবে ধর্ষণের মতো গ্লানিকর নয়। তার পোষাকে কোন অশালীনতা আমি দেখিনি। কিন্তু যারা আক্রমণ করেছেন তাদের কথা হচ্ছে শুধু-পুরুষদের একটি সমাবেশে নারী সাংবাদিক কেন এসেছেন? নারীদের শালীনতার প্রশ্নই যদি প্রধান হয় তাহলে কোন্‌ ধরণের সভায় নারী যাবে আর কোনটাতে যাবে না সেটাও কি ঠিক করে দেয়া হবে? আমি মনে করি বিষয়টি এতো চরম নিয়ন্ত্রণের দিকে নিয়ে যাওয়া উচিৎ হবে না। সাধারণভাবে বললে নারীদের পোশাক সম্পর্কে আমাদের সামাজিক যে প্রধান বোধবুদ্ধি ও সচেতনতা তা নিজে থেকেই যথেষ্ট শালীন ও ভারসাম্যপুর্ণ।এই দিকটাকে আমলে নিয়ে হেফাজতের নেতা কর্মীদের সতর্ক থাকার দরকার আছে। যেকোন জবরদস্তি উলটা ফল বয়ে আনতে পারে।

মিডিয়া কর্মীদের উপর আক্রমণ নিন্দনীয়। আবার এমন ঘটনা শুধু হেফাজতের সমাবেশেই নয়, অতি আধুনিকদের গানের কনসার্টেও হতে দেখেছি আমরা। যেখানে শুধুই পুরুষ। একা নারীর ওপর আক্রমন কোন ধর্মীয় কারণে নয়, পুরুষতান্ত্রিক কারণেই হয়।

মিডিয়া কর্মীদের উপর আক্রমণ নিন্দনীয়। আবার এমন ঘটনা শুধু হেফাজতের সমাবেশেই নয়, অতি আধুনিকদের গানের কনসার্টেও হতে দেখেছি আমরা। যেখানে শুধুই পুরুষ। একা নারীর ওপর আক্রমন কোন ধর্মীয় কারণে নয়, পুরুষতান্ত্রিক কারণেই হয়।

হেফাজতে ইসলামের পঞ্চম দাবী “ইসলাম বিরোধী নারীনীতি, ধর্মহীন শিক্ষানীতি বাতিল করে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা”। 
এখানেও একাধিক বিষয় টেনে আনা হয়েছে। আমি শুধু নারী নীতি প্রশ্নেই থাকতে চাই।

প্রথমেই বলে রাখা ভাল যে বাংলাদেশ সরকার কোন নারী নীতি ঘোষণা করেন নি, যেটা আছে সেটা হচ্ছে ‘নারী উন্নয়ন নীতি’।
 দাতারা যেভাবে বুঝেছে সেই দিক থেকে “উন্নয়নের” জন্যে নারীদের কোন্‌ কোন্‌ দিকগুলো প্রাধান্য দেয়া হবে তারই নীতি। কাজেই আমরা কোন্‌ নীতি নিয়ে বিতর্ক করছি তা আগে পরিস্কার থাকতে হবে।

তিন




নারী উন্নয়ন নীতি নিয়ে ভাল করে বুঝতে হলে আমাদের এর পেছনের কথা জানতে হবে। এই নীতি প্রণয়নের সাথে নারী আধিকার প্রতিষ্ঠার সম্পর্কের চেয়ে নারী উন্নয়নের সম্পর্ক অনেক বেশী। ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগে নারী উন্নয়ন নীতি প্রণয়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই সময় দেশের নারী সংগঠনগুলো একসাথে কাজ করেছিল। আমরা নিজেরাও সেই প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত ছিলাম। এর একটি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতও রয়েছে। ১৯৯৫ সালে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত বিশ্ব নারী সম্মেলনের ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পনার অংশ হিশেবে এই নীতি প্রণীত হয়। তার আগে ১৯৭৯ সালে জাতি সংঘের নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (CEDAW) গৃহিত হয়। বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৪ সালে চারটি ধারায় ২, ১৩(ক), ১৬(ক) ও (চ)সংরক্ষণসহ এ সনদ অনুসমর্থন করে। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে ধারা ১৩(ক) এবং ১৬.১ (চ)সংরক্ষণ প্রত্যাহার করা হয়। ধারা ২ হচ্ছে রাষ্ট্র সমুহের সংবিধান ও আইন সমূহে নারী-পুরুষের সমতার নীতি অনুসরণ। ধারা ১৩(ক) পারিবারিক কল্যাণের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। ধারা ১৬ হচ্ছে বিবাহ ও সকল পারিবারিক বিষয়ে নারী-পুরুষের সমান অধিকার; ১৬.১ স্বামী-স্ত্রীর অধিকার, সন্তানের ব্যাপারে পিতা-মাতার অধিকার, সন্তান গর্ভধারণে নারীর অধিকার ইত্যাদী মৌলিক বিষয়গুলো রয়েছে। ১৯৯৬ সালে ১৩(ক) এবং ১৬.১(চ) প্রত্যাহার করা হয়েছে। ১৬.১(চ) -এ অভিভাবকত্ব, দত্তক গ্রহণ, ট্রাস্টশিপ ইত্যাদী ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের অধিকারের কথা রয়েছে।

সিডও সনদে স্বাক্ষর করেছিলেন হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ সরকার, বেইজিং কর্মপরিকল্পনায় স্বাক্ষর করেছিলেন বিএনপি সরকার; বেগম খালেদা জিয়া প্রধান মন্ত্রী হিশেবে বেইজিং গিয়েছিলেন। তারই আলোকে নারী উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন করেছেন আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৭ সালে। ২০০৪ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকার এই নীতিতে পরিবর্তন ঘটায় এবং নারী উন্নয়ন নীতি ২০০৪ প্রণয়ন করে। আবার ২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংশোধিত আকারে নারী উন্নয়ন নীতি ২০০৮ প্রণয়ন করে। যদিও তারা সেটা বাস্তবায়ন করতে পারেন নি। কাজেই নারী উন্নয়ন নীতি প্রণয়নে সব সরকারই সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছে। কারণ দাতাগোষ্ঠির কাছে নারী উন্নয়ন নীতি তাদের উন্নয়ন সহযোগিতার একটি অপরিহার্য অংশ।

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় অঙ্গীকার করলেও নারী উন্নয়ন নীতি ঘোষণা করেছে অনেক দেরীতে, ২০১১ সালে। প্রায় ৪১টি লক্ষ্য সামনে রেখে প্রণীত এই নীতিতে নারীর সম-অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিদ্যমান আইন সংশোধন ও প্রয়োজনীয় নতুন আইন প্রণয়ন করার কথা ছাড়া ধর্মীয় দিক থেকে আপত্তি তোলার মতো কিছুই নাই।

হেফাজতে ইসলাম নারী নীতি পুরোটার বিরোধিতার করছেন না, তাঁরা নারী নীতির ইসলাম বিরোধী ধারা বিলুপ্ত করতে বলছেন। আল্লামা আহমদ শফীর দেয়া ব্যাখ্যায় বলা হয়েছেঃ “ত্যাজ্য সম্পত্তিতে সম-অধিকারের আইনসহ নারীনীতির পবিত্র কোরআন-সুন্নাহবিরোধী ধারাগুলোই আমরা সংশোধনের দাবি করছি”। 
হেফাজতে ইসলাম যদি সর্বশেষ নারী নীতি (২০১১) পড়ে থাকেন তাহলে দেখবেন নারী উন্নয়ন নীতির ২৫.২ ধারায় বলা হয়েছে “উপার্জন, উত্তরাধিকার, ঋণ, ভূমি এবং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান করা”। 
 এখানে অর্জিত সম্পদের ওপরই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে বেশী। সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে পরিচ্ছন্ন বা স্পষ্ট ভাবে কিছু বলা হয় নি। বলাবাহুল্য, এই দিকটি একটি বিষফোঁড়ার মতো সমস্যা হয়ে রয়েছে। এই ক্ষেত্রে প্রচুর আলোচনা তর্কবিতর্কের প্রয়োজন আছে।

আমরা দেখেছি, জোট সরকারের নারী উন্নয়ন নীতি থেকে উত্তরাধিকার সম্পদ কথাটি বাদ দেয়া হয়েছিল, পরে ২০০৮ সালের তত্ত্ববাধায়ক সরকারের নারী উন্নয়ন নীতিতে উত্তরাধিকার শব্দটি না রেখে “স্থাবর ও অস্থাবর” শব্দ যোগ করা হয়। ২০০৮ সালে ওলামা মাশেয়খদের প্রতিবাদের কারণে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত খতিব মুফতি মুহাম্মদ নুরুদ্দিনকে প্রধান করে প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রণয়ন করতে একটি কমিটি করে দেয়া হয়। এ কমিটি ২০০৮ সালের নীতিমালার ১৫টি ধারা কোরআন-সুন্নাহর পরিপন্থী বলে উল্লেখ করেন। এর মধ্যে তারা সিডও বাস্তবায়ন-সংক্রান্ত ধারাটি বাতিলের সুপারিশ করেন (কালের কন্ঠ, ৭ মার্চ, ২০১০)।



আমরা দেখেছি, জোট সরকারের নারী উন্নয়ন নীতি থেকে উত্তরাধিকার সম্পদ কথাটি বাদ দেয়া হয়েছিল, পরে ২০০৮ সালের তত্ত্ববাধায়ক সরকারের নারী উন্নয়ন নীতিতে উত্তরাধিকার শব্দটি না রেখে “স্থাবর ও অস্থাবর” শব্দ যোগ করা হয়। ২০০৮ সালে ওলামা মাশেয়খদের প্রতিবাদের কারণে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত খতিব মুফতি মুহাম্মদ নুরুদ্দিনকে প্রধান করে প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রণয়ন করতে একটি কমিটি করে দেয়া হয়। এ কমিটি ২০০৮ সালের নীতিমালার ১৫টি ধারা কোরআন-সুন্নাহর পরিপন্থী বলে উল্লেখ করেন। এর মধ্যে সিডও বাস্তবায়ন-সংক্রান্ত ধারাটি বাতিলের সুপারিশও করা হয়।

নারী উন্নয়ন নীতির ব্যাপারে ২০০৮ সাল এবং ২০১১ সালে ওলামা মাশায়খরা প্রতিবাদ করেছেন এবং তাঁদের নিজস্ব মতামত তুলে ধরেছেন। সরকারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে তাঁদের কথা দিয়েছেন যে কোরআন -সুন্নাহ বিরোধী কোন আইন সরকার অতীতেও করে নি, ভবিষ্যতেও করবে না। তাঁর সাথে সুর মিলিয়ে কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীও বিভিন্ন সভায় বলেছেন কোরআন -সুন্নাহ বিরোধী কোন আইন করা হবে না। কিন্তু মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ড. শিরীণ শারমিন চৌধুরী ১৯৯৭ সালে নীতিমালা অনুযায়ী উত্তরাধিকার বিষয়টি নতুন নীতিমালায় পুনর্বহাল করেন। বলা বাহুল্য তিনি নারী সংগঠনের সাথে পরামর্শ করেই করেছেন।ফলে দেখা যাচ্ছে, নারী উন্নয়ন নীতিতে উত্তরাধিকারের বিষয়টি সরকার আসলে কতখানি রাখছেন তা তাঁরা নিজেরাই নিশ্চিত নন। সরকার একদিকে নারী সংগঠন, অন্যদিকে ইসলাম পন্থীদের এ বিষয়ে অস্পষ্ট রেখে দিয়েছেন। নারী আন্দোলন মাঝখানে বিভ্রান্ত হয়েছে। যেটাই হোক, নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ পূর্ণাঙ্গ রূপে ঘোষিত হয়েছে বটে, কিন্তু বাস্তবায়ন পুরোপুরি হয় নি।

দেখা যাক, ইসলামি চিন্তাবিদ ও ওলামা মাশায়েখরা নারী উন্নয়ন নীতির মধ্যে কোন ধারাগুলোকে কোরআন -সুন্নাহ বিরোধী মনে করছেন। কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. মুহাম্মদ ইনাম উল হক এই ধারা গুলো চিহ্নিত করে লিখেছেন। তাঁর মতে ক. ১৬.১ বাংলাদেশ সংবিধানের আলোকে প্রণীত ও গণজীবনের সব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা আনা সম্ভব নয়। ক. ১৬.৮ নারী-পুরুষের বিদ্যমান বৈষম্য নিরসন করার বিষয়টিই পরিস্কার নয়। গ. ১৭.৪ বিদ্যমান সব বৈষম্যমূলক আইন বিলোপ করা এবং আইন প্রণয়ন ও সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত কমিশন বা কমিটিতে নারী আইনজ্ঞদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার প্রস্তাব কোরআন ও সুন্নাহ’র সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক।

হেফাজতে ইসলাম তাঁদের ১৩ দফায় এতো কথা বলেন নি, তাঁরা শুধু বলেছেন নারী নীতি ইসলাম বিরোধী। আমরা পত্র-পত্রিকায় আলেম সমাজের পক্ষ থেকে যে সমালোচনা দেখছি, হেফাজতে ইসলামও কি একই মতের কিনা তা আমরা জানি না। যদি হয়ে থাকেন তাহলে বলবো তাঁদের আপত্তি যেখানে সেটা নারী উন্নয়ন নীতিতে খুব জোরালো ভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি। কিন্তু নারী উন্নয়ন নীতির বিরোধিতা যেভাবে করা হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে হেফাজতে ইসলাম নারীদের সকল প্রকার উন্নয়নের বিরুদ্ধে, যা তাঁরা নন বলেই ইতিমধ্যে বিভিন্ন আলোচনায় তারা পরিস্কার করেছেন। তাহলে তাঁদের উচিত হবে এই ব্যাপারে হেফাজতের নারী সংগঠন ও অন্যান্য নারী সংগঠনের সঙ্গে মত বিনিময় করা। নারী আন্দোলন যখন দাবী করে নারী নীতি সব নারীদের জন্যে, সেখানে হেফাজতের পুরুষদের মতামত ছাড়াও হেফাজতের নারীদের মতামত শোনাও আমাদের প্রয়োজন। অন্যদিকে নারী্রা সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে যেভাবে এগিয়ে এসেছেন সেই বাস্তবতাকে মনে রেখেই আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। যেসব ক্ষেত্রে পশ্চিমা চিন্তার প্রভাবের কারণে নারী উন্নয়ন নীতির যেসব দিক আমাদের স্বার্থের প্রতিকুল বলে মনে হচ্ছে অবশ্যই সেগুলোর বিষয়ে সমালোচনা হতে পারে। কিন্তু ঢালাও ভাবে কোন কিছু বাতিল বা সমর্থন করা যাবে না।

হেফাজতের পক্ষ থেকে জাতিসংঘের বিতর্কিত সিডও সনদ বাতিলের দাবি জানানো হয়েছে। এটা ঠিক যে আন্তর্জাতিক যে কোন সনদে পশ্চিমা দেশের চিন্তা চেতনার প্রাধান্য থাকবে এবং এর বিরুদ্ধে খোদ পশ্চিমা দেশের ধর্মীয় নেতারা শুধু নয়, আরও অনেকেই প্রতিবাদ করেছেন, বিশেষ করে পোপ ও ভ্যাটিকানরা খুশি নন। তার অর্থ হচ্ছে শুধু ইসলামী ওলামারাই নন অন্যান্য ধর্মের পক্ষ থেকেও সিডও সনদ গৃহীত হচ্ছে না। সিডও সনদ সংক্রান্ত তর্ক যথেষ্ট জটিল বিষয়। তবে জাতি সংঘের সনদ হিশেবে ধরে নিয়ে নিজ দেশের প্রেক্ষাপটে কিভাবে গ্রহণ করা যায় সে আলোচনা অবশ্যই আমাদের করতে হবে। সেই ক্ষেত্রে হেফাজতে ইসলামসহ সমাজের সকল স্তরের জনগণের অংশগ্রহণ জরুরী।

আশা করি নারী নীতি নিয়ে এই সকল বিভ্রান্তি আমরা নারীদের মধ্যে আরও আলোচনার মধ্যে সমাধান করতে পারবো। তার আগে নারীদের দুই পক্ষ হয়ে পরস্পরের বিরোধী অবস্থান নেওয়া কৌশলগত ভাবে ভুল হবে বলে আমি মনে করি।

Saturday, April 20, 2013

প্রথম আলোতে হাসনাত আব্দুল হাইয়ের আলোচিত


'টিভির ক্যামরার সামনে সেই মেয়েটি’

মেয়েটি অনেকক্ষণ ধরে তার পেছনে পেছনে ঘুরছে, সেই অনুষ্ঠান শেষে হলঘর থেকে বেরিয়ে আসার পর থেকে যখন তার চারদিকে ভক্ত ও তদবিরবাজদের ভিড়। এত ছেলেমেয়ের মাঝখানে সাদামাটা প্রায় ময়লা কাপড়ে উসর-ধূসর চুল মাথায় বিদ্ঘুটে রঙের সালোয়ার-কামিজ পরা মেয়েটির প্রতি তার চোখ পড়ার কথা না, তবু পড়ল। এতে তিনি বিস্মিত হলেন এবং কিছুটা বিরক্তও। অনেকেই তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। কেননা, তিনি শুধু একজন সেলিব্রিটি নন, ইংরেজিতে যাকে বলে ফেভার। তা অন্যের প্রতি দেখানোর মতো তার যথেষ্ট ক্ষমতাও আছে। সেলিব্রিটির পেছনে, ছেলেমেয়েরা ঘোরে মুগ্ধতার জন্য অথবা কিছু পাওয়ার আশায়। সংসারে সবারই কিছু না কিছু চাওয়ার আছে। জীবন যতই জটিল হচ্ছে, চাওয়ার তালিকা বেড়েই যাচ্ছে। চারদিকে প্রতিযোগিতার দৌড় জীবনকে আরও জটিল করে তুলছে।
মেয়েটি নাছোড়বান্দা, তিনি যতই তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন, সে ঘুরে এসে দাঁড়ায় সামনে, প্রথম সারিতে না হলেও দ্বিতীয় কি তৃতীয় সারিতে। দেখতে সে সুশ্রী নয়, তবে তার চোখে-মুখে তীক্ষ একটা ভাব আছে, নতুন ছুরির মতো। তার চোখের নিচে ক্লান্তির কালো দাগ, মুখে একধরনের রুক্ষতা। আগে সেখানে যে কমনীয়তা ছিল তা মুছে ফেলেছে। ঠোঁট দুটি চকচক করছে, যেন গ্লিসারিন মাখানো। আসলে সে ঘন ঘন জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নিচ্ছে। গলার নিচে কণ্ঠি বের হয়ে এসেছে, ওপরের দিকে গলার মধ্যে কয়েকটি ভাঁজ, সেখানে ঘামের পানি জমে আছে রুপার চিকন হারের মতো। শুকনো খড়ের মতো চুল উড়ছে বাতাসে। প্রায় ময়লা সবুজ ওড়না লাল কামিজে জড়ানো শরীরের ওপরে একটা স্তন ঢেকে রেখেছে, বুকের অন্য পাশে ওড়না কামিজের কাপড়ের ওপর ছড়িয়ে রাখা, প্রায় সমতল দুই দিকেই, হঠাৎ দেখে ছেলে কি মেয়ে বোঝা যায় না। মেয়েটি বাংলাদেশের পতাকার রং দিয়েই সালোয়ার-কামিজ বানিয়েছে অথবা সেই রকম তৈরি করা কাপড় কিনেছে। আজকাল অনেকেই এভাবে কাপড় পরে, কিছুটা দেশপ্রেম দেখাতে, কিছুটা ফ্যাশন স্টেটমেন্টের জন্য। মেয়েটা দেখতে সুশ্রী না হলেও বয়সের জন্য একধরনের আকর্ষণ আছে তার শরীরে। অগোছালো বেশবাস সেই আকর্ষণে একটা বন্যতার ভাব সৃষ্টি করেছে, যেন সে যেখানে খুশি লাফিয়ে পড়তে পারে। দেখেই মনে হয় খুবই বেপরোয়া আর অ্যাগ্রেসিভ।
বুঝলেন স্যার, ওরা আমার সঙ্গে পলিটিকস করছে। সামনের সারিতে থাকতে দিচ্ছে না। অথচ এই কদিন আমি সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে থেকে স্লোগান দিয়েছি। আমার গলার স্বর এত উঁচু যে মাইক্রোফোনের বলতে গেলে দরকার হয় না। এক মাইল দূর থেকেই শুনে বুঝতে পারবেন এটা আমার গলার স্বর। মিটিংয়ের জন্য স্লোগানের দরকার, স্লোগানই মিটিং জমিয়ে তোলে। আপনি নিশ্চয়ই জানেন। অভিজ্ঞ লোক আপনি। আমি কয়েক দিন মিটিং জমিয়ে রেখেছি শুধু আমার গলার জোরে স্লোগান দিয়ে দিয়ে। কাগজে আমার নাম এসেছে। টেলিভিশনে আমাকে প্রায়ই দেখিয়েছে। পাবনা থেকে দেখে আমার ছোট বোন ফোনে বলেছে, আপু তোকে দেখা গিয়েছে। কয়েকবার। তুই খুব মাতিয়ে রেখেছিস। আমার মাও প্রশংসা করেছেন দেখে। কেন করবেন না? নিজের মেয়ের খ্যাতিতে কোন মা গর্ব অনুভব করে না? বাবা? না, তিনি কিছু বলেননি। বেতো রুগি, বিছানায় শুয়ে থাকেন সব সময়। শুনেছি, ছোট বোনকে বলেছেন, ও ঢাকা গেল পড়াশোনা করতে। এখন মিছিল-মিটিং আর মানববন্ধন করে সময় নষ্ট করছে। ওর পড়াশোনার কী হবে? জমির ভাই তো পড়ার কথা বলেই ওকে নিয়ে গেলেন ঢাকায়। এখন এসব কী হচ্ছে? ওর ভবিষ্যৎ আমার চোখের সামনে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
জমির ভাই, মানে আমার বাবার অনাত্মীয় জমির সাহেবকে জানেন স্যার? আমরা তাকে চাচা বলি। তিনি একজন রাজনৈতিক নেতা, মফস্বল শহর পাবনা থেকে শুরু করেছিলেন রাজনীতি, আস্তে আস্তে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ঢাকায় পৌঁছেছেন। বাবার সঙ্গে জানাশোনা অনেক দিন থেকে। আগে প্রায় প্রতিদিন আসতেন, ঢাকায় আসার পর যান মাঝেমধ্যে। একদিন আমাদের বাসায় এসে বললেন, তোমার বড় মেয়েটা বেশ চটপটে আছে। ওকে ঢাকায় পাঠাও। মফস্বলে থেকে কত দূর আর যেতে পারবে? এখানে কি-ই বা সুযোগ রয়েছে? এখন সবই তো ঢাকায়।
ঢাকায় গিয়ে কী করবে সীমা? ওর তো গ্র্যাজুয়েশনও হয়নি। বাবা বলেছিলেন।
শুনে জমির চাচা উত্তর দিয়েছিলেন, কেন? ঢাকাতেই গ্র্যাজুয়েশন করবে। সেই ব্যবস্থা করে দেব আমি। কলেজ ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে জানাশোনা আছে। বললেই অ্যাডমিশন হয়ে যাবে। হোস্টেলেও জায়গা পেতে অসুবিধা হবে না। সবই তো রাজনৈতিক দলের কন্ট্রোলে, যখন যারা ক্ষমতায় থাকে, তাদের। এখন আমরা আছি, সব সিদ্ধান্ত আমরাই নিই। কে অ্যাডমিশন পাবে, কার জন্য সিট খালি করাতে হবে—এ সবই আমাদের আওতায়। বুঝলেন না, একটা সিস্টেম তৈরি হয়ে গিয়েছে। বেশ সুন্দর চলছে। কেউ বাদ সাধছে না, কোনো হট্টগোল নেই। সবাই পাবে এই সুযোগ, পালা করে। বেশ গণতান্ত্রিক এই ব্যবস্থা। তা ছাড়া দলের কেউ না হলেও এসব সুযোগ পাওয়া যায়। একটু খরচ করতে হয় আর কি। সে যাই হোক, আপনার মেয়েটার দায়িত্ব আমি নিলাম। ও ঢাকায় যাবে, কলেজে ভর্তি হবে, হোস্টেলে থাকবে। পড়াশোনা করবে। মাঝেমধ্যে আমাদের পার্টি অফিসে এসে এটা-ওটা নিয়ে কাজ করে সাহায্য করবে।
কী কাজ করবে? কী নিয়ে সাহায্য করতে হবে সীমাকে? বাবার স্বরে উদ্বেগ ও ব্যাকুলতা।
তেমন কিছু না। ধরেন নেতার জন্য বক্তৃতা লেখা, প্যামফ্লেট তৈরি, প্রচার পুস্তিকা লেখা, ব্যানারের স্লোগান—এই সব আরকি। বড় ধরনের কোনো কাজ না, জটিলও না। খুব বেশি সময় দিতে হবে না তাকে। পড়াশোনার কোনো ক্ষতি হবে না।
বাবা শুনে আমার দিকে তাকিয়েছেন। মাথা নেড়ে বলেছেন, ও অমন কাজ আগে কখনো করেনি। পারবে না। তা ছাড়া ওই সব নিয়ে থাকলে পড়াশোনা লাটে উঠবে।
জমির চাচা আশ্বাস দিয়ে বললেন, কাজগুলো সব সোজা। লেখালেখি, তা-ও বাংলায়। ছোট ছোট আকারে। তাতে সময় বেশি লাগবে না। আর পড়াশোনার সময় তো সে এসব কাজ করবে না, অবসরে করবে। সন্ধ্যার পর। কখনো রাতে।
সন্ধ্যার পর, রাতে? বাবা খুব চিন্তিত হয়ে তাকিয়েছেন জমির চাচার দিকে। বলেছেন মাথা দুলিয়ে কাঁপা গলায়, শুনেছি, সন্ধ্যার পর ঢাকার রাস্তাঘাট নিরাপদ না। গুন্ডা-বদমাশ ঘুরে বেড়ায়। ইভটিজার পিছু নেয়।
আরে না। ওসব বাড়িয়ে বলে লোকে। ঢাকা রাজধানী, সেখানে আইনশৃঙ্খলা থাকবে না তো থাকবে কোথায়? অন্য সব মেয়ে থাকছে না ঢাকায়? কাজ করছে না, ঘোরাঘুরি করছে না? মজার ব্যাপার কি জানেন?
কী? বাবার চোখে একরাশ কৌতূহল এবং পুরোনো প্রশ্ন।
ঢাকায় মফস্বলের মেয়েরাই বেশি ফ্রি, বেশি দুরন্ত, বেশ সাহসী। ওরা কাউকে পরোয়া করে না। সব পার্টিতেই তারা আছে। টেলিভিশনে দেখেন না, মিছিলের সময় সামনে থেকে কেমন হাত তুলে জোরে জোরে স্লোগান দেয়। মফস্বলের মেয়েরাই ঢাকায় আন্দোলন জমিয়ে রাখে। বলতে গেলে ওরাই আসল কর্মী দল। ছেলেগুলো ফাঁকিবাজ। তারা মেয়েদের দিয়েই সব কাজ করিয়ে নিতে চায়। শুধু বাহবা আর টাকা নেওয়ার সময় সামনে থাকে। সব কাজের ক্রেডিট নেয়। জমির চাচা অনেকক্ষণ কথা বলে থামেন।
স্যার, কিছুই জানা ছিল না আমার, মফস্বলের মানুষ, তা-ও আবার মেয়ে। অল্প সময়ে অনেক কিছু শিখলাম। হয়তো আরও শেখার আছে। মেয়েদের সারা জীবনটাই জানার। ছাত্রী হয়েই থাকতে হয় সবকিছু জানার জন্য। অ্যাপ্রেন্টিস বলে না? আমরা হলাম তাই। কিন্তু আমি আর পারছি না স্যার। আমার একটা চাকরি দরকার। ভদ্রলোকের, ভদ্রমেয়ের মতো চাকরি। আপনি দিতে পারেন। আপনার তো সেই সুযোগ রয়েছে। আমার বেশি কিছু দেওয়ার নেই, সবই তো দেখতে পাচ্ছেন। প্রায় দেউলে হয়ে গিয়েছে শরীর আর মন। দেওয়ার মতো কিছু হয়তো একসময় ছিল, এখন তেমন কিছু নেই। মিথ্যে বলব কেন। আপনি অভিজ্ঞ লোক। সেলিব্রিটি।
তিনি বিরক্ত হয়ে বলেন, তোমার একটা দোষ আছে। তুমি বেশি কথা বল।
মেয়েটি শুনে মিইয়ে যায়। তারপর বলে, জমির চাচা কোথায়? আছেন, তিনি তার জায়গাতেই আছেন, দলের কাজ করছেন উঠে-পড়ে, দলে আরও কিছুটা ওপরে উঠতে পেরেছেন। অনেক ফন্দিফিকির জানেন তিনি। কী করে ডিঙিয়ে যেতে হয়, ওপরের মানুষকে তুষ্ট করতে হয়, সব জানা আছে তার। তিনি আরও ওপরে উঠবেন।
আমি? না, আমার পক্ষে ওপরে ওঠা সম্ভব হবে না। যেটুকু উঠেছি, ওই পর্যন্ত। মানববন্ধন করি, মিছিলে যাই, মঞ্চ তৈরি করে তার ওপরে উঠে গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিই। টেলিভিশনে দেখায়। কাগজে নাম ছাপা হয়। পাবনা থেকে ছোট বোন প্রশংসা করে ফোনে জানায়। মা-ও খুশি, তার মেয়েকে টেলিভিশনে দেখা যাচ্ছে, সবাই তার কথা বলছে। মা আমাকে নিয়ে গর্ব করেন বলে শুনেছি।
পড়াশোনা? হ্যাঁ, জমির চাচা তাঁর কথা রেখেছিলেন। কলেজে অ্যাডমিশন হয়েছে। হোস্টেলে শেয়ারে সিট পেয়েছি, মানে দুজনে একসঙ্গে থাকতে হয়। ক্লাস বেশি হয় না, প্রায়ই বন্ধ থাকে। আমরাও ফুরসত পাই না। হরতাল, মিটিং, মিছিল। মঞ্চে উঠে স্লোগান দেওয়া। এতে অনেক সময় চলে যায়। তবে কলেজে নামটা আছে খাতায়। হোস্টেলে সিটটা আছে এখনো। কেউ আপত্তি করে না, কেন করবে? প্রায় সবাই তো আমার মতো অবস্থার। কারও অনুগ্রহে অ্যাডমিশন আর সিট পাওয়া। সন্ধ্যার পর পড়াশোনা? না, সেটা প্রায় কারোরই হয় না। সবাই কিছু না কিছু নিয়ে ব্যস্ত, টাকার ধান্দায় ঘোরে। আমি পার্টি অফিসে যাই। কখনো একা, কখনো ছাত্রনেতাদের সঙ্গে। জমির ভাইয়ের অফিসে বসে বক্তৃতা লিখি, কখনো লিফলেট। কম্পিউটারে প্রিন্ট আউট বের করে দেখাই। তিনি প্রুফ দেখে দেন। আবার টাইপ করি। এসব কাজ ছেলেরা করতে চায় না। তারা মারধর, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, ভাঙচুর—এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কাজ শেষ হলে আড্ডা দেয়, ড্রিংক করে একসঙ্গে বসে।
ড্রিংক? না, না। চা-টা না। অ্যালকোহল। হুইসকি। বিয়ার। আমাকেও খেতে হয়েছে পাল্লায় পড়ে। ওদের সঙ্গে থাকতে হলে তাদের সমর্থন পাওয়ার জন্য নানাভাবে সঙ্গ দিতে হয়। এড়ানোর উপায় নেই। ওরা নেতাদের কাছে নালিশ করলে আমাদের ভাতা বন্ধ। দেড় হাজার টাকা ভাতা পাই আমি অফিস থেকে, তাই দিয়ে কলেজে পড়া, হোস্টেলে থাকা। খুব মূল্যবান সেই ভাতা। বোকামি করে হারাতে পারি না। তাহলে যে পথে বসব।
জমির ভাইকে বলোনি কেন এসব? কী যে বলেন! তিনি কি ধোয়া তুলসি পাতা? তিনিও ড্রিংক করেন। রাতে কাজ শেষ হয়ে গেলে অফিসে বসেই করেন। আমাকেও খেতে হয়েছে তার সঙ্গে। আদর করে জড়ানো গলায় বলেছেন, খাও, খাও। ভালো জিনিস। স্বাস্থ্য ভালো থাকে। এনার্জি বাড়ায়। এত পরিশ্রম করার পর দরকার আছে এটার। সাহেবরা তো খারাপ জিনিস তৈরি করেনি। অল্প অল্প খাও, তাহলে বেসামাল হবে না। একটু সামলে চলতে হবে, হাজার হোক এটা পার্টি অফিস। বেসামাল হতে চাও তো আমার বাসায় এসো। তোমার ভাবি? আরে সে থাকলে তো! কেউ নেই, বাসা খালি। মারা গিয়েছে? না, মারা যাবে কেন? মেয়েরা অত তাড়াতাড়ি মরে না। এই ঝগড়া করে চলে গেল আরকি। বলল, রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে ঘর করা পোষাবে না তার। কয়েক বছর একসঙ্গে থাকার পর এই কথা বলা। এত দিন যখন সহ্য করতে পেরেছে, তখন বাকিটাও পারত। কোনো মানে হয় হঠাৎ করে এসব কথা বলার? যারা দেশের জন্য খাটছে দিন-রাত, তাদের কিছু খামখেয়ালি, নিয়ম ভেঙে চলা—এসব সহ্য করতে না পারলে চলবে কেন? শুনল না মেয়ে মানুষটা। চলে গেল। যাক গে। বেশ আছি। হাত-পা ঝাড়া। চাকর আছে, রাঁধুনি আছে বাসায়। খাওয়া-দাওয়ার অসুবিধা হচ্ছে না, ঘুমোবার সময় বেশ ঘুমোচ্ছি। হ্যাঁ, তোমার যখন খুশি যেতে পারো। ওদের বললেই তোমাকে খেতে দেবে। দোকানে দোকানে সব সময় খাওয়া ভালো না লাগারই কথা। সেই তো বিরিয়ানি, নয়তো পরোটা-গোশত। কত দিনের পুরোনো কে জানে। স্বাদ বদলের জন্য এসো আমার বাড়ি মাঝে মাঝে। যখন খুশি। আমি বলে রাখব। জমির চাচা বললেও আমি সঙ্গে সঙ্গে তার বাসায় যাইনি। আমার মনে বেশ সন্দেহ জমেছিল। আস্তে আস্তে লোকটার চেহারা খুলে যাচ্ছিল আমার সামনে।
জমির চাচা নিজেই একদিন নিয়ে গেলেন তার বাসায়। প্রায় জোর করেই ড্রিংক করালেন ড্রয়িংরুমে বসে। সেদিন বেশিই খাওয়া হয়ে গিয়েছিল, তারই চাপে। ড্রিংকের পর পোলাও-কোর্মা খাওয়া হলো। খুব ফুর্তি লাগছিল। অমন মজা করে খাইনি অনেক দিন। তিনি যখন অনেক রাতে বললেন, দেরি হয়ে গিয়েছে। এখন হোস্টেলে যাওয়া ঠিক হবে না। থেকে যাও এখানে।
তাঁকে বেশি করে বলতে হলো না। থেকে গেলাম প্রায় স্বেচ্ছায়। সেই শুরু। তারপর বেশ কয়েক দিন হয়েছে অমন, একসঙ্গে ড্রিংক করা, খাওয়া আর ঘুমানো। দলের ছেলেরা তো বোকা না, টের পেয়ে গিয়েছে। ঠাট্টা করেছে, মিসট্রেস বলে। গায়ে মাখিনি। এমন ভাব করেছি, যেন শুনতেই পাইনি। ওরা ঠাট্টা করা বন্ধ করেনি।
জমির চাচাকে কেন বলিনি ওদের কথা? এই জন্য বলিনি যে জমির চাচা ওদের কিছু বলবেন না। তাদের নিয়ে কাজ করতে হয় তাকে।
তিনি রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছেন, অনেক জায়গাজুড়ে মঞ্চ। রাস্তায়, ফুটপাতে মানুষের ভিড়। অল্প বয়সের ছেলেমেয়েই বেশি। স্লোগান উঠছে থেকে থেকে, কোলাহল বাড়ছে। তিনি সীমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি মঞ্চে যাবে না আজ? স্লোগান দিতে?
না। ছাত্রনেতারা পলিটিকস করছে আমার সঙ্গে। বলছে, তাদের খাদ্য হতে হবে। শুধু জমির চাচার একার খাদ্য হলে চলবে না। রাতের বেলা মঞ্চের আশপাশে তাদের সঙ্গেও শুতে হবে। তাহলেই হাতে মাইক্রোফোন দেবে, নচেৎ নয়।
শুনে তিনি অবিশ্বাসের চোখে তার দিকে তাকান। রাস্তার স্লোগান ক্রমেই জোরালো হয়। তিনি সীমা নামের মেয়েটিকে বলেন, মাইক্রোফোন ওরা কন্ট্রোল করে? ওরাই ঠিক করে কে কখন স্লোগান দেবে?
তা নয় তো কী? ওরাই তো মঞ্চের নেতা। ওদের কথা যারা মানবে না, তারা হাতে মাইক্রোফোন পাবে না। গলা যত সুন্দরই হোক। আমার মতো ভরাট গলা হলেও চান্স পাবে না। মেয়েটি হঠাৎ তার দিকে তাকিয়ে বলল, শুনবেন স্যার? একটা স্লোগান দেব? আমার ভরাট গলায়?
না, না। দরকার নেই। এমনিতেই বুঝতে পারছি তোমার গলা বেশ ভরাট। রেডিও, টিভি অ্যানাউন্সারদের মতো, নিউজ রিডারের মতো।
মেয়েটি খুব খুশি হয় শুনে। হাসিমুখে বলে, সত্যি বলছেন স্যার? টিভি অ্যানাউন্সার, নিউজ রিডারের মতো? বলতে বলতে মেয়েটির চোখ ভিজে এল। ধরা গলায় বলল, আমার মতো অধঃপতিত মেয়ের ভাগ্যে কি তা হবে কখনো? হতে পারত যদি খারাপ হয়ে না যেতাম। ভালো পথে চলতাম। ভালো লোকের সঙ্গে মিশতাম। কিন্তু তা কী করে সম্ভব? আমার মতো অবস্থার একটা মেয়ে ভালো পথে কী করে চলবে? ভালো মানুষের সঙ্গ সে কোথায় পাবে? হাজার চেষ্টা করলেও তা হবে না। পাবনা থেকে ঢাকা অনেক দূরের পথ। আমি তো জানি পথের বাধাগুলো কোথায় কোথায় দাঁড়িয়ে। না, অত বড় কিছুর কথা ভাবতে পারি না আমি এখন। ছোটখাটো একটা চাকরি পেলেই বর্তে যাব। যেকোনো কাজ, যা ভদ্রভাবে চলতে দেবে, সুন্দরভাবে থাকতে দেবে। আচ্ছা স্যার, আপনার টেলিভিশন চ্যানেলে লেখাটেখার কোনো কাজ নেই? আমি খুব ভালো বাংলা লিখি। কবি শামসুর রাহমানের ওপর লেখা আমার কয়েকটা প্রবন্ধ আছে। অনেকে প্রশংসা করেছিল। আরও কয়েকটা লিখে একটা বই বের করব ভেবেছিলাম। কিন্তু সময় হলো না। ইচ্ছেটা এখনো আছে।
জমির চাচাকে বলব? তিনি উড়িয়ে দেবেন কথাটা। বলবেন, কবি-টবিদের ওপরে বই লিখে কী হবে? তার চেয়ে আমাদের দলের ওপর লেখো। দলের নেতাদের ওপর লেখো। তারপর একটু থেমে বলেছেন, তোমার অসুবিধা কোথায়? এই সব কথা তোমার মাথায় ঢোকে কেন? মাসে তিন হাজার টাকা পাচ্ছ। সেই টাকায় কলেজের ফি, হোস্টেলের খরচ দিচ্ছ। এই বয়সে এর চেয়ে ভালো চাকরি আর কী হতে পারে? তাও আবার পার্টটাইম। পরীক্ষায় পাস করার পর বেশি বেতনে চাকরি পেয়ে যাবে, তখন তুমি শুধু শামসুর রাহমান কেন, সব কবিদের নিয়ে লিখবে। এখন তোমাকে আমার অফিসের কাজের জন্য বেশি দরকার। ছাত্রনেতারা হাসি-ঠাট্টা করে? তা একসঙ্গে করলে বন্ধুরা অমন করবেই, গায়ে না মাখালেই হলো অথবা হেসে উড়িয়ে দেবে। আর শোনো, আমাকে না বলে ছাত্রনেতাদের সম্পর্কে কিছুই বলতে যাবে না। ওরা রেগে গেলে সবকিছু করতে পারে। দল ভেঙে অন্য কোথাও যাওয়ারও চেষ্টা কোরো না। দলের ছেলেরা সেটা সহ্য করবে না। ওরা সাংঘাতিক কিছু করে ফেলবে। দলের ছেলেমেয়েদের দলে রাখা তাদের জন্য একটা প্রেসটিজের ব্যাপার। ইচ্ছে করলেই কাউকে চলে যেতে দেওয়া যায় না। ঢোকা সহজ, বেরোনো কঠিন। বুঝলে? মাথা ঠিক রেখে কাজ করো। সমস্যা হলেই আমার কাছে চলে আসবে, খোলাখুলি সব বলবে।
জমির সাহেব মঞ্চের ছেলেদের বলছেন না কেন তোমাকে মাইক্রোফোন দেওয়ার জন্য? তিনি মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করেন।
বলছেন না এই জন্য যে তিনি তাদের সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করতে চান না। তা ছাড়া ব্যাপারটা নাটকের মতো। পেছন থেকে প্রম্পটার যা বলছে, তাই নিয়ে স্লোগান হচ্ছে, সে অনুযায়ী সবকিছু চলছে। বাইরে থেকে কিছু বোঝা যায় না। জমির চাচা মঞ্চের পেছন থেকে সামনে আসতে যাবেন কেন? তিনি এবং তার বন্ধুরা টাকা দিয়ে যাচ্ছেন, খাওয়ার প্যাকেট পাঠাচ্ছেন। মঞ্চ চালু থাকছে, মিছিল বের হচ্ছে। ব্যস, এতেই তারা সন্তুষ্ট। একটা মেয়ের জন্য তিনি কিংবা তার সহকর্মীরা ছাত্রনেতাদের খেপাতে যাবেন কেন? নিজের দুর্বলতা থাকলে এমনই হয়। না, জমির চাচাকে বলে কিছু হবে না। সে আমার জানা আছে। হাতে মাইক্রোফোন পাওয়ার একটাই উপায়। ছাত্রনেতাদের কথা শুনতে হবে। সোজা কথায়, তাদের খাদ্য হতে হবে। হ্যাঁ স্যার, আমার মতো মেয়েরা সবাই খাদ্য। তারা মেনে নিয়েছে, ইচ্ছায় এবং অনিচ্ছায়। কী করবে? বাবার এত টাকা নেই যে তার খরচে ঢাকায় থাকবে। চাচা নেই, মামা নেই যে সাহায্য করতে পারেন। একমাত্র জমির চাচারা আছেন। তারা আগ বাড়িয়ে সাহায্য করতে আসেন। বড় মিষ্টি তাদের ব্যবহার। প্রায় অপত্যস্নেহে তাঁরা সঙ্গে নিয়ে ঘোরেন।
মেয়েটি প্রসঙ্গ বদলায়। বলে, আপনাকে টেলিভিশনে দেখেছি, টকশোতে আপনার কথা শুনেছি। আপনাকে অন্য রকম মনে হয়েছে। মানে অন্য পুরুষদের মতো না। আমার ভুলও হতে পারে। কিন্তু সত্যিই আপনাকে দেখে আমার এমন মনে হয়েছে। তা স্যার, পারবেন আমার জন্য কিছু করতে? বড় কিছু না। মঞ্চের আড়ালেই থাকব, লেখালেখি কিছু থাকলে করে দেব। টেলিভিশনেও লেখার কাজ নিশ্চয়ই আছে?
এই বইটা থেকে পড়ব? কতটুকু? এক প্যারা? বেশ পড়ছি। বলে মেয়েটি পড়তে থাকে এক মনে। পড়া শেষ হলে সে তাকে বলে, ক্যামন হলো স্যার? স্লোগান দিয়ে দিয়ে গলাটা ভেঙে গিয়েছে। নরমাল হলে আর একটু ভালো হতো। তা লেখালেখির কাজের জন্য তো গলার স্বরের দরকার নেই। আমার লেখা প্রবন্ধগুলো আপনাকে দেব। কবি শামসুর রাহমানের ওপর লেখা প্রবন্ধ। আমার খুব প্রিয় কবি ছিলেন। ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতাটি পড়লেই আমার গায়ের রোমকূপ দাঁড়িয়ে যায়। আমি প্রবন্ধগুলো আপনার অফিসে গিয়ে দিয়ে আসব। আপনার কাছে পৌঁছাবে কি না কে জানে। কত রকমের সিকিউরিটি আপনাদের অফিসে। তবু আমি দিয়ে আসব।
তিনি পকেট থেকে মোবাইল বের করে চোখের সামনে নিয়ে একটা নম্বরে টিপ দিলেন। তারপর ওপাশে কণ্ঠস্বর শোনা যেতেই তিনি বললেন, একটা মেয়ে যাবে অফিসে। নাম সীমা। ওর একটা অডিশন নেবে। হ্যাঁ, সে একটা কিছু পড়ে যাবে, যা তোমরা তাকে দেবে। শোনার পর নিজেদের মধ্যে আলোচনা করবে। তারপর আমাকে তোমাদের মত দেবে। হ্যাঁ, আমিও শুনব তার রেকর্ড করা অডিশন।
স্যার, আমি টেলিভিশনে অডিশন দেব? সত্যি বলছেন? না, না ঠাট্টা করবেন না আমার সঙ্গে। আমি এর মধ্যেই জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছি। আর বাড়াতে চাই নে কষ্টের বোঝা। স্যার, চাকরি না দেন, আমার সঙ্গে ঠাট্টা করবেন না। আমি মফস্বলের সামান্য একজন মেয়ে, তার ওপর আবার অধঃপতিত। পড়ে গেলে নাকি ওঠা কঠিন। আমি একটু দেখতে চাই, পড়ে গেলেও ওঠা যায় কি না, তার জন্য ছোট একটা সুযোগ দেন শুধু।
তিনি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি খুব বেশি কথা বল।
শাহবাগ চত্বর লোকে লোকারণ্য। সব বয়সের মানুষ নর-নারীতে ভরে গিয়েছে সব রাস্তা, ফুটপাত। সবাই ব্যগ্র হয়ে তাকিয়ে আছে দক্ষিণের দিকে, যেখানে জাতীয় জাদুঘর, পাবলিক লাইব্রেরি আর তারপর আর্ট ইনস্টিটিউট। হকাররা ভিড়ের মধ্যে নানা ধরনের জিনিস বিক্রি করছে। খেলনা, খাবার জিনিস—সবই। লাল আর সাদা হাওয়াই মিঠাইয়ের পেজা তুলার মতো ফাঁপানো শরীর প্লাস্টিকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। বাবার কাঁধে চড়ে একটা শিশু হাওয়াই মিঠাই খাচ্ছে, কাঁধে চড়েই কেউ বাতাসে খেলনা নাড়ছে। বাঁশি বাজাচ্ছে এক হকার, গলায় ঝোলানো ঝোলায় বিক্রির বাঁশি। শুকনো মিষ্টি বিক্রি করছে ঠেলাওয়ালা। বাতাসে ভাজা-পোড়ার গন্ধ। শিশুপার্কের সামনে এক চিলতে জায়গায় ফকির আলমগীর তাঁর দল নিয়ে লালনসংগীত গাইছেন ফিউশন সুরে।
একটু পরে আর্ট ইনস্টিটিউট থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হলো। সঙ্গে সঙ্গে ভিড়ের মধ্যে ঢেউয়ের মতো একটা চঞ্চলতা আছড়ে পড়ল। পেপিয়ার-ম্যাশে তৈরি মস্ত বড় বাঘ, প্যাঁচা, ময়ূর মাথার ওপরে তুলে এগিয়ে আসছে শোভাযাত্রার ছেলেমেয়েরা। উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে যেন, চঞ্চল হয়ে উঠেছে ভিড়ের মানুষ। গরমে ঘামছে সবাই, লাল হয়ে এসেছে মুখ। ধুলো উড়ছে, বাতাসে রোদের ঝাঁজ।
মেয়েটি ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে বলছে, ‘নতুন বর্ষকে স্বাগত জানিয়ে এগিয়ে আসছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। এতক্ষণ যারা অধীর প্রতীক্ষায় ছিল, হাজার হাজার সেই সব নর-নারী শিশু-কিশোরের প্রতীক্ষা শেষ হলো। গান শোনা যাচ্ছে, এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।’ বলতে বলতে মেয়েটির স্বর ক্রমেই উঁচু হলো। এত কোলাহল, গানের চড়া সুর, তার ভেতরে মেয়েটির কণ্ঠস্বর স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। সে পরেছে লাল পেড়ে সাদা সুতির একটা শাড়ি। তার এক হাতে ছোট গাঁদা ফুলের মালা বালার মতো জড়িয়ে।

Sunday, April 14, 2013

নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কয়ারে বিক্ষোভে





নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কয়ারে বিক্ষোভ বিস্তারিত




নিউ ইয়র্ক: বাংলাদেশে ন্যায় বিচার ও শান্তির দাবীতে নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনের টাইমস স্কয়ারে আমেরিকার মুসলিম সংগঠনগুলোর এক বিশাল বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ১৩ এপ্রিল শনিবার আমেরিকানস ইউনাটেড ফর হিউম্যান রাইটস এ বিক্ষোভ সমাশের আয়োজন করে। সমাবেশ শেষে টাইমস স্কয়ারে বিক্ষোভকারীরা এক র‌্যালী বের করে। 



বিক্ষোভে বাংলাদেশে চরম মানবাধিকর লংঘন, ট্রাইবুনালের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে দেশটির শীর্ষস্থানীয় ইসলামী নেতৃবৃন্দসহ বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে মৃত্যুদন্ড দেয়ার প্রক্রিয়া এবং গণহত্যার প্রতিবাদ জানানো হয়। এছাড়াও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মুক্তির দাবী করা হয়। এসময় আমেরিকান মুসলিম নেতারা বার্মার আরাকান প্রদেশে মুসলিম নিধন বন্ধের আহবান জানান। অনুষ্ঠিত সমাবেশে বাংলাদেশী আমেরিকানদের সামাজিক, ধর্মীয় ও কমিউনটি সংগঠন ছাড়াও মূলধারার বিভিন্ন সংগঠনসহ ১২ টি আমেরিকান মুসলিম সংগঠনের ৮/১০ হাজার নেতা কর্মী অংশ নেয়। 
কেয়ার এর এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর নিহাদ আওয়াদ বলেন, আমি আওয়ামী লীগ, বিএনপি কিংবা জামায়াত করিনা। একজন আমেরিকান মুসলমান হিসেবে বাংলাদেশের মুসলমানদের পক্ষে কথা বলছি। দেশটি মুসলমানরা নির্যাতিত হচ্ছে। সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিম দেশ হওয়ার পরও ইসলাম ও রাসূল (সাঃ) এর কুৎসা রটনা করা হয়। রাসূল (সাঃ) কে কটাক্ষকারীদের বিচার দাবী নিয়ে দেশটির মুসলমানরা আন্দোলন করে যাচ্ছে। আন্দোলকারী মুসলমানদের উপর সরকারী বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালিয়ে  হত্যা করা হচ্ছে। গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের উপর নির্যাতন করা হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত মানবতা বিরোধী অপরাধের গঠিত ট্রাইবুনাল কার্যক্রম ইতোমধ্যেই বিতর্কিত হয়ে পড়েছে। ট্রাইবুনালের একটি রায় নিয়ে দেশী সহিংসতায় গণহত্যার ঘটনা উদ্বেগজনক। ৪২ বছর আগের ঘটনার বিচার করতে গিয়ে সংঘাতময় পরিস্থিতি কোন ভাবেই কাম্য হতে পারেনা। আমরা বাংলাদেশে শান্তি ও মুসলমানদের প্রতি ন্যায় বিচার চাই। 
তিনি বলেন, ট্রাইবুনালের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে মনে হচ্ছে ইসলামী সংগঠনের নেতৃবৃন্দকে হত্যার করার জন্য ৪২ বছর পূর্বের একটি ইস্যুকে সামনে আনা হয়েছে। 





ইসলামিক সার্কেল অফ নর্থ আমেরিকা-ইকনার আমীর নাঈম এম বেগ বলেন, বিশ্ববিখ্যাত আলেম মাওলানা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদন্ডের রায় ঘোষণা শুরু করার পর সারা দেশে প্রতিবাদের যে ঝড় উঠেছে তা দমন করতে গিয়ে গত ফেব্রুয়ারী ও মার্চ মাসে সরকার গণহত্যা চালিয়েছে।
তিনি বলেন, সরকারের বিভিন্ন বাহিনী ও দলীয় ক্যাডারদের নির্বিচার গুলিবর্ষণে ২ শতাধিক নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, কয়েক হাজার লোক আহত হয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে এবং অসংখ্য মানুষকে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করে বিনাবিচারে কারাগারে আটক রাখা হয়েছে। 
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর পরিকল্পিতভাবে নির্যাতন করে বিভিন্ন ইসলামী সংগঠনের উপর দোষ চাপানো হচ্ছে। বক্তারা স্বাধীন বিচার কমিশন গঠণ করে এসব হত্যার তদন্ত করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনার দাবী জানান। 
মুসলিম উম্মাহ অফ নর্থ আমেরিকা-মুনার ন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট আবু আহমেদ নূরুজ্জামান বলেন, বর্তমান সরকার বিরোধী শক্তির ১ লাখের অধিক নেতা কর্মীকে মামলা দিয়ে কারাগারে প্রেরণ করেছে। এছাড়াও প্রতিনিয়ত বিরোধী শক্তির নেতা কর্মীদের গুম ও খুন করা হচ্ছে। এক কথায় দেশটিতে চরম মানবাধিকার লংঘন হচ্ছে। তাই একজন আমেরিকান মুসলমানরা মানবাধিকার রক্ষার জন্য বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাড়িয়েছে। 



তিনি আরো বলেন, ৪২ বছর আগে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সংঘটিত অপরাধের দায়ভার পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের এবং সেসময় যারা দেশটির পরিচালনায় নিয়োজিত ছিলেন সেসব বেসামরিক লোকদের। স্বাধীনতার পর পর বাংলাদেশ সরকার চিহ্নিত ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে ভারতের মধ্যস্থতায় ১৯৭৪ সালে মুক্তি দিয়েছে। দীর্ঘ চার দশক পর সরকার তার প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে মিথ্যার তীর ছুঁড়ে তাদেরকে ঘায়েল করতেই প্রহসনে বিচারের ব্যবস্থা করেছে। অবিলম্বে তথাকথিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বাতিল করে ইতোমধ্যে যেসব নেতার বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডাদেশ দেয়া হয়েছে তাদের দন্ড প্রত্যাহার ও ট্রাইব্যুনাল বাতিল করে বর্তমান সংকট নিরসনের মাধ্যমে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে একটি ট্রুথ এন্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠণ করে সমঝোতায় উন্নীত হওয়ার আহবান জানান।



আমেরিকানস ইউনাইটেড ফর হিউম্যান রাইটস এর সভাপতি মোবাশ্বির রহমান বলেন, বাংলাদেশ সরকারকে আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে জাতিসংঘের তত্বাবধানে বসনিয়া, রুয়ান্ডা, সিয়েরা লিওনের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের অনুরূপ নতুন ট্রাইব্যুনাল গঠণ করে প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিচার করার উদ্যোগ নেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রতি আহবান জানান। 
তিনি বলেন, বর্তমান ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম বিচার প্রক্রিয়া বহির্ভূত ও বিদেশে অবস্থানরত একজন অজ্ঞাত পরিচয় আইনজীবীর সাথে স্কাইপে ও ই-মেইলের মাধ্যমে বিচার সম্পর্কিত আলোচনা এবং নির্দেশনা নিয়ে ট্রাইব্যুনালকে বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য প্রমাণ করেছেন। এধরনের কেলেঙ্কারির পর এই আদালতের অস্তিত্ব বজায় রেখে নির্দোষ লোকদের হত্যা করার ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাওয়া কোন মতেই মেনে নেয়া যায় না। 
সমাবেশে থেকে বক্তারা মায়ানমার সরকারের ছত্রছায়ায় রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর গত কয়েক দশক যাবত নিপীড়ন চালানো এবং মুসলিম জনগোষ্ঠীর নাগরিক অধিকার অব্যাহতভাবে অস্বীকার করে যাওয়া এবং তাদের ধর্মীয় স্থাপনা একের পর এক ধ্বংস করার চেষ্টার প্রতিবাদ করে তাদেরকে মায়ানমারের নাগরিকত্ব প্রদানের আহবান জানান।
অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত করে মাওলানা জুলকিফুল চৌধুরী। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ আবু সামীহাহ সিরাজুল ইসলাম ও নতুন প্রজন্মের আকিব আজাদের পরিচালনায় স্বাগত বক্তব্য আমেরিকানস ইউনাইটেড ফর হিউম্যান রাইটস এর সভাপতি মোবাশ্বির রহমান। 



সমাবেশে আরো বক্তব্য রাখেন, কেয়ার নিউ ইয়র্কের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াদ রামাদান, মজলিস আস শুরার আমীর ইমাম আলহাজ্ব তালিব আবদুর রশীদ, মুনার ন্যাশনাল এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন, ইন্টারনেট ইসলামিক ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ জহিরউদ্দিন, হিউম্যান রাইটস ডেভেলপমেন্ট ফর বাংলাদেশ-এইচআরডিবির প্রেসিডেন্ট মাহতাব উদ্দিন আহমেদ, ওম্যান রাইটস এন্ড ডেভেলপমেন্ট ফর বাংলাদেশ এর চেয়ারপার্সন শাহানা মাসুম, পার্ক আমেরিকান সোসাইটির প্রেসিডেন্ট শামস উজ জামান, মজলিস আস শুরার জাষ্টিস ডিপার্টমেন্টের চেয়ারপার্সন ইমাম আইয়ুব আবদুল বাকী, মজলিস আস শুরার সাবেক আমীর ইমাম আল আমীর আবদুল লতিফ, বাইস এর শুরা সদস্য ডা: মোহাম্মদ জুন্নুন চৌধুরী, যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ডা: মুজিবুর রহমান মজুমদার, যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি’র সিনিয়র সহ-সভাপতি গিয়াস আহমেদ, যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান জিল্লু, বিএনপি নেতা ডা: গুলজার আহমেদ, মানবাধিকার কর্মী বিউটি আকন্দ, মসজিদ বায়তুশ শরফের ইমাম জাকারিয়া মাহমুদ, হিলসাইড ইসলামিক সেন্টারের প্রেসিডেন্ট আবদুল আজিজ ভূঁইয়া, দারুল কোরআন ওয়া সুন্নাহ’র ইমাম মুফতি রুহুল আমিন প্রমুখ। সমাবেশে বাংলাদেশ ও মায়ানমারের উপর লিখিত সুপারিশ পাঠ করেন নতুন প্রজন্মের শারমিন ও ইশরাত রুমা।  



আমেরিকার ঐতিহাসিক টাইমস স্কয়ারে বেলা ১২ টা থেকে ৩ টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বিক্ষোভে আমেরিকান মুসলমানরা অংশ নেন। বিক্ষোভে অংশ নেয়ার জন্য সকাল থেকে নিউ ইয়র্কের বিভিন্ন স্থান থেকে বাস, সাবওয়ে ও প্রাইভেট গাড়ীতে নারী, পুরুষ ও তরুণ তরুণীরা টাইম স্কয়ারে জমায়েত হয়। সবার হাতে ছিলো বিভিন্ন ধরণের শ্লোগান লেখা প্লেকার্ড। এগুলোর মধ্যে উল্লেখ্য হলো- সেইভ বাংলাদেশ, গণহত্যা বন্ধ কর, নারী নির্যাতন বন্ধ কর, দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী, মাওলানা নিজামী, গোলাম আজম, আলী আহসান মুজাহিদ ও মীর কাসেম আলীকে মুক্তি দাও দিতে হবে। এছাড়াও সাংবাদিক মাহমুদুর রহমানের মুক্তি দাবী করে শ্লোগান ও প্লেকার্ড প্রদর্শন করা হয়। বিক্ষোভের ফাঁকে ফাঁকে জামায়াত নেতাদের মুক্তি এবং শেখ হাসিনার পদত্যাগ দাবী করে শ্লোগান দেয়া হয়। 
ব্যস্তততম নগরীতে এতো বড় বিক্ষোভ দেখে আমেরিকানরা থমকে দাড়িয়ে ছিলো। অনেকেই বিক্ষোভের কারণ জিজ্ঞাসা করতে থাকে। বিক্ষোভের সংবাদ গুরুত্ব দিয়ে আমেরিকার বেশ কয়েকটি মিডিয়াতে স্থান পায়। আয়োজকরা এ বিক্ষোভকে বাংলাদেশের ইস্যূতে আমেরিকায় সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ বলে দাবী করেছেন।  


http://coalitionbdus.blogspot.com/2013/04/blog-post_202.html
ছবি নিউজে যে সব ছবি বাদ পড়েছে: 













                     


সর্ব প্রথম নিউজ http://coalitionbdus.blogspot.com/2013/04/blog-post_1226.html