বৃহস্পতিবার দুপুরে দলের নায়েব আমীর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাইদীকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়ার পরে সারা দেশে জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ শুরু করেন।
দলটির নেতাকর্মীদের বিক্ষোভ দমন করতে পুলিশ-র্যাবের গুলিবর্ষণ করলে ও সরকাদলীয় নেতা-কর্মীদের সশস্ত্র হামলা চালালে জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের বহু নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন।
দলটির ভারপ্রাপ্ত আমীর মকবুল আহমাদ এক বিবৃতিতে দাবি করেছেন, সারা দেশে কমপক্ষে ৫০ জন নিহত ও তিন হাজারেরও বেশি মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। গুলিবিদ্ধদের মধ্যে প্রায় পাঁচশ’ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
তবে এখন পর্যন্ত আমরা নিশ্চিত হয়েছি সারা দেশে কমপক্ষে ৪৪ জন মানুষ নিহত হয়েছেন।
নিহতদের মধ্যে রয়েছেন- ঢাকায় দুইজন, সিরাজগঞ্জে দুইজন, ঠাকুরগাও পাঁচজন, গাইবান্ধায় তিন পুলিশসহ ছয়জন, নোয়াখালীতে চারজন, চট্টগ্রামে তিনজন, সাতক্ষীরায় পাঁচজন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে দুইজন, কক্সবাজারে দুইজন, দিনাজপুরে দুই জন, রংপুরে সাতজন, বগুড়ায় একজন, মৌলভীবাজারে তিন জন।
বৃহস্পতিবারের এই বিপুল রক্তপাত কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। গত ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই পুলিশের গুলি, সরকার দলীয় নেতা-কর্মীদের হামলা ও রাজনৈতিক সহিংসতা থেকে প্রাণ রক্ষার্থে পালাতে গিয়ে মানুষ নিহত হয়েছেন। ২০ দিনে খুন হয়েছেন ২৪ জন।
http://www.facebook.com/photo.php?v=138409692994091&set=vb.100004751830916&type=2&theater
এর আগে গত জানুয়ারি মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত ১৭ জন মানুষ। যাদের মধ্যে গত ২৯ জানুয়ারি চট্টগ্রামে চার জন; ৩১ জানুয়ারি বগুড়ায় চার জন ও ফেনীতে এক জন নিহত হন।
অন্যদিকে, ২০০৯ থেকে ২০১২ পর্যন্ত চার বছরে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন ৩০ জন মানুষ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কর্মী। আর রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৭৭৫ জন মানুষ।
আমরা মনে করি, রাজনৈতিক পক্ষগুলোর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও আদর্শিক লড়াইয়ের দোহাই দিয়ে এই বিপুল প্রাণহানির ঘটনাকে গ্রহণযোগ্য করা সম্ভব হবে না। এই সব প্রাণহানির ব্যাপারে সবাইকে সংবেদনশীল ও দায়শোধে ইচ্ছুক এমন দায়িত্বশীল হতে হবে।
কারণ, মুক্তিযুদ্ধের মতো এক মহান গণযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ। এ রাষ্ট্রের একটি সংবিধান রয়েছে। এই সংবিধানের বলে ধর্ম-বর্ন-শ্রেণী-পেশা-দল-মত নির্বিশেষে দেশের সব মানুষের পরিচয় হল তারা বাংলাদেশের নাগরিক।
নাগরিক মাত্রই সাংবিধান নাগরিক অধিকারে অধিকারী। এই অধিকার বলে সবার নিরাপদ জীবন ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের বাধ্যবাদকতা রয়েছে।
যেহেতু বাংলাদেশের সংবিধান এখনও বহাল আছে, সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাও ক্রিয়াশীল, সেহেতু দিনের পর দিন রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নির্বিচারে নাগরিকের প্রাণহানি ঘটতে পারে না।
যদিও অনেক দিন ধরেই আমরা পুলিশ বাহিনীর কর্মকর্তাদের ও সরকারের পক্ষ থেকে একটি বক্তব্য শুনছি যে, জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের ‘নাশকতা’ ‘তাণ্ডব’ ও ‘সহিংসতা’ দমন করতে পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে গুলি চালাতে হচ্ছে।
কিন্তু, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঐতিহ্য ও জনসংস্কৃতির জায়গায় এ বক্তব্য কোন ভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
বর্তমান ও সাবেক আমীরসহ জামায়াতের ৯ জন শীর্ষ নেতা ’৭১-এ মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগে কারাগারে বন্দি রয়েছেন। তাদের মধ্যে দলটির নায়েব আমীর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ ও ২।
এ অবস্থায় দলটির নেতাকর্মীরা বিক্ষুব্ধ হবেন, রাস্তায় বিক্ষোভ দেখাবেন এবং বলপ্রয়োগের চেষ্টা করবেন, এটি স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এ ধরনের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় বিক্ষুব্ধ মানুষ সহিংস ও আক্রমণ প্রবণ হয়ে ওঠে।
ঔপনিবেশিক বৃটিশ রাজের উত্তরসুরি বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীগুলো সরকারবিরোধী রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার এই স্বাভাবিকতা ও প্রবণতা সম্পর্কে অজ্ঞাত এটি কোন ভাবেই বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না।
পাশাপাশি পুলিশ ও সরকারে এমনটি অজানা নয় যে, জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হওয়ার কারণে বাংলাদেশে রাজনৈতিক গোষ্ঠীর রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণে গুলি চালানো যায় না।
জাতিসংঘের অষ্টম কংগ্রেসে গৃহীত ‘আইন প্রয়োগকারী বাহিনী কর্তৃক বল প্রয়োগ ও অস্ত্রের ব্যবহার বিষয়ক মূলনীতি’ মোতাবেক বিক্ষোভকারী জনতা ও রাজনৈতিক দলের কর্মীদের সঙ্গে দায়িত্বশীল আচরণ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে পুলিশের।
এ অবস্থায় আমরা প্রতিনিয়ত বিপুল প্রাণহানি দেখে এমনটি ভাবতে বাধ্য হয়ে পড়ছি যে, গুলি চালানো পুলিশ বাহিনী ও সরকারের নীতিগত ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।
কিন্তু আমরা মনে করি, দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পেশাদারিত্বে বিপুল ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
এ কারণেই বিক্ষুব্ধ জনতাকে নিয়ন্ত্রণে লাঠিচার্জ, টিয়ারশেল নিক্ষেপের মত লঘু বলপ্রয়োগ না করে গুলি চালানোর মত অন্যায় করছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
আর সাম্প্রতিক বন্দুকবাজি ও অকারণে বলপ্রয়োগ দেখে ধারণা করা যায় যে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের সাংবিধানিক নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকার সম্পর্কে দায়িত্বশীল হতে যথেষ্ঠ দীক্ষা দেয়া হয়নি।
আমরা এও মনে করি, বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে পরিচালনার বেলায় নেতৃত্বের অমার্জনীয় অদক্ষতা ও অযোগ্যতা রয়েছে। নেতৃত্বের মধ্যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও সংবেদনশীলতার অভাব অত্যন্ত প্রকট।
বিশেষ করে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী পরিচালনায় নিযুক্ত মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর মধ্যে দায়িত্বশীলতা, মানবিক সংবেদনশীলতা ও জবাবদীহিতার ঘাটতি অত্যন্ত দুঃখজনক ও ভীতিকর।
আমরা বলতে চাই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বন্দুকবাজির ফলে সমাজে যে শোক ও ক্ষত তৈরি হয়েছে তার ব্যাপারে দেশের সব নাগরিককে সংবেদনশীল হতে হবে। এ ব্যাপারে অনেক আগেই সবার দায়িত্বশীল ভূমিকা দৃশ্যমান করা দরকার ছিল।
সবার অবহেলায় পরিস্থিতি যে, দিকে গিয়েছে তাতে করে রাষ্ট্রের সংহতি, জাতীয় নিরাপত্তার ও জননিরাপত্তাহীনতা তৈরি হওয়ার নৈর্বত্তিক শর্ত তৈরি হয়ে গেছে।
এ অবস্থায় কৌশলী ও দায়িত্বশীল ভূমিকার বদলে বন্দুকবাজি অব্যাহত রাখলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, সামাজিক স্থিতিশীলতা ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার মত পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। যা আমরা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য মনে করি না।
আমরা মনে করি, ইতোমধ্যে সংঘটিত প্রাণহানির ব্যাপারে জবাবদিহিতা ও বিচারিক প্রক্রিয়া নিষ্পত্তি করলে, নিহতদের স্বজনদের ন্যায় বিচার ও ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তি নিশ্চত করলে পরিস্থিতির অবনতি রোধ করা সম্ভব হবে।
রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোকে বিপুল প্রাণহানির ব্যাপারে দায়িত্বশীল আচরণ করে সব প্রাণহানির বিচার ও দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়াকে প্রধান ভূমিকা রাখতে হবে।
আর যদি মানবাধিকার সংগঠন, নাগরিক সমাজ ও সংবাদমাধ্যম মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের পক্ষে পক্ষপাতহীন, গণতান্ত্রিক, দায়িত্বশীল ও সংবেদনশীল আচরণ করলে ভবিষ্যতের বন্দুকবাজি ও প্রাণহানি বন্ধ হবে।
No comments:
Post a Comment