মাওলানা সাঈদীর রায় নিয়ে
ব্যারিস্টার রাজ্জাকের পর্যালোচনা
ডেস্ক রিপোর্ট : জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র নায়েবে আমীর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়ের প্রতিক্রিয়ায় ডিফেন্স টীমের প্রধান কৌঁসুলি ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, এই রায় অবিশ্বাস্য। আমরা স্তম্ভিত। প্রসিকিউশন অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি তারপরেও মৃত্যুদন্ড দেয়া হলো। এটা দুঃখজনক। সাক্ষ্য প্রমাণ অনুযায়ী মৃত্যুদন্ড দূরে থাক, এক মিনিটেরও সাজা হওয়ার কথা নয়। তার বিরুদ্ধে এই রায় সম্পূর্ণভাবে ন্যায়ভ্রষ্ট। রায়ের বিরুদ্ধে মাওলানা সাঈদীর ওপর চরম অবিচার করা হয়েছে। তিনি নির্দোষ। তাকে বেকসুর খালাস দেয়া উচিত ছিল। আমরা সংক্ষুব্ধ। রায়ের বিরুদ্ধে নির্ধারিত সময়ে আপিল করা হবে। আশা করি আপিলে আমরা সুবিচার পাব।
ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক যে দু'টি হত্যাকান্ডের অভিযোগে মাওলানা সাঈদীকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে তার ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, বিশাবালী হত্যার ঘটনায় তার ভাই সুখরঞ্জন বালী ট্রাইব্যুনালে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষী দিতে এসেছিলেন। দেশবাসীসহ সকলের জানা আছে সরকারের আইনশৃক্মখলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে তুলে নিয়ে যায় ট্রাইব্যুনালের গেট থেকে। এরপর থেকে তার আর হদিস নেই। আরেকটি হলো ইব্রাহিম কুট্টি হত্যাকান্ড। ইব্রাহিম কুট্টির স্ত্রী ১৯৭২ সালে থানায় একটি এজাহার দায়ের করেছেন। সেখানে মাওলানা সাঈদীর নাম নেই। আমরা আদালতে এই এজাহারের কপি দাখিল করেছি। এখন কিভাবে মৃত্যুদন্ড দেয়া হলো সেটাই প্রশ্ন। এই দু'টি ঘটনায় মৃত্যুদন্ড দেয়ায় আমরা সতিকার অর্থে বিস্মিত। উই আর রিয়েলি সারপ্রাইজড। রাজনৈতিক বিবেচনায় রায় দেয়া হয়েছে কি না সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে জবাবে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী বলেন, মাওলানা সাঈদীর মামলাটি সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমরা ট্রাইব্যুনালে এই অভিযোগের পক্ষে অনেক প্রমাণ উত্থাপণ করেছি।
যুবক সাঈদীর সাজা বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের মন্তব্যের বিষয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, বয়স কতো ১৮, ৩০ না ২ সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। আইনের চোখে এই প্রশ্ন মূল্যহীন। প্রশ্ন হলো রাষ্ট্রপক্ষ তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এনেছে সেগুলো যথাযথ আইনী প্রক্রিয়ায় প্রমাণ করতে পেরেছে কি না। আমরা বলব রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। সবগুলো অভিযোগকে আমরা মিথ্যা প্রমাণ করেছি। তারপরেও অন্যায়ভাবে মাওলানা সাঈদীকে সাজা দেয়া হলো।
শাহবাগের আন্দোলনের ফলে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে বা এর প্রভাব পড়েছে কি না এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, এটা আইনের কোন বিষয় নয়। বিচারকরা সংবিধান, আইন এবং তার বিবেক অনুসারে বিচার কাজ করেন। বাইরে থেকে কে কি বললো সেটা বিবেচ্য হওয়া উচিত নয়।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ধানমন্ডির বাসভবনে রায়ের প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন ডিফেন্স টীমের আইনজীবী এডভোকেট মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
লিখিত প্রতিক্রিয়ায় ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেন, মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামী চিন্তাবিদ। তিনি একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় মুফাসসিরে কুরআন।
গতকাল বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করা হয়েছে। তাঁকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে। আমরা মনে করি তার বিরুদ্ধে এই রায় সপূর্ণভাবে ন্যায়ভ্রষ্ট। এই রায়ের মাধ্যমে মাওলানা সাঈদীর ওপরে চরম অবিচার করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের উচিৎ ছিল তাঁকে সপূর্ণ নির্দোষ ঘোষণা করে খালাস দেয়া।
মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে আনীত ২০টি অভিযোগের মধ্যে ১৬টি অভিযোগ ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধের। ৪টি ছিল গণহত্যার। একটি অভিযোগও তারা প্রমাণ করতে পারেনি। প্রসিকিউশন ২৮ জন সাক্ষীর বক্তব্য উপস্থাপন করেছে। প্রত্যেকটি সাক্ষীর বক্তব্য অসত্য প্রমাণ করতে আসামী পক্ষ সক্ষম হয়েছে।
এর বাইরে ১৬ জন সাক্ষীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বা আদালতে আনা সম্ভব নয় বলে বক্তব্য দিয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট তাদের কথিত বক্তব্যকে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। তাদেরকে জেরা করা সম্ভব হয়নি। কথিত এই খুঁজে না পাওয়া সাক্ষীদের মধ্যে একজন ঊষারাণী মালাকার টেলিভিশনে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বলেছেন যে, তার স্বামী হরলাল মালাকারের হত্যার সাথে মাওলানা সাঈদী কোনভাবেই জড়িত নন। অপর দু'জন আদালতে এসে প্রসিকিউশন যে তাদের নামে মিথ্যা বক্তব্য দিচ্ছে তা বলতে চেষ্টা করেছেন। তার মধ্যে বহুল আলোচিত ভাগীরথির ছেলে গণেশ সাহা আদালতে দাঁড়িয়ে তার মায়ের ব্যাপারে সাঈদী সাহেবকে জড়িয়ে প্রসিকিউশন যে মিথ্যাচার করেছে তা তুলে ধরেছেন। অপর জন সুখরঞ্জন বালী তার ভাই বিশাবালী হত্যার ব্যাপারে সরকার পক্ষের মিথ্যাচার ফাঁস করে দেয়ার জন্য আদালতের দরজা পর্যন্ত আসতে পারলেও পুলিশ সেখান থেকে তাকে ৫ নবেম্বর অপহরণ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আজো জানা যায়নি তিনি বেঁচে আছেন নাকি তাকে হত্যা করা হয়েছে।
মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো যে কত বড় মিথ্যাচার, সুখরঞ্জন বালীর প্রতি সরকারের আচরণ থেকে তা প্রমাণিত। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হলো যে সাক্ষীদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে প্রচার করা হচ্ছিল। কাউকে কাউকে সর্বোচ্চ ৪৫ দিন পর্যন্ত সরকারের হেফাজতে সেফ হাউসে আটকে রাখা হয়েছিল। মিথ্যা সাক্ষী দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত ওই সাক্ষীরা মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজি না হলে তাদেরকে অজ্ঞাত স্থানে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। এর প্রমাণ হিসেবে পাঁচ শতাধিক পৃষ্ঠার দলিলপত্র আমরা আদালতে উপস্থাপন করেছিলাম। বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বাধীন তদানীন্তন ট্রাইব্যুনাল এই অকাট্য প্রমাণ গ্রহণ করেনি।
পরবর্তীতে বিচারপতি নিজামুল হকের স্কাইপ কেলেঙ্কারি প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলাদেশের জনগণসহ গোটা বিশ্ব দেখেছে কিভাবে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অসত্য সাক্ষ্য দিয়ে বিচারক এবং প্রসিকিউশনের যোগসাজশে এমনকি বিদেশ থেকে মামলার গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট, আদেশ এবং রায় তৈরি করে মাওলানা সাঈদীকে মৃত্যুদন্ড দেয়ার অপচেষ্টা চালানো হয়েছিল। বিচারপতি নিজামুল হকের স্কাইপ সংলাপ এবং ই-মেইল থেকে প্রাপ্ত এসব অকাট্য দলিল ঐ ট্রাইব্যুনালের সামনে আসার পরেও এই ট্রাইব্যুনাল সেগুলোকে আমলে নিয়ে মামলা পুনঃবিচারের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন যা বিচার বিভাগের ইতিহাসে এক বড় কলঙ্কজনক ঘটনা। এভাবে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মাওলানা সাঈদী মিথ্যাচার ও অবিচারের স্বীকার হয়েছেন।
আইনে সুযোগ থাকার পরেও প্রসিকিউশনের ২৮ জন সাক্ষীর বিপরীতে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে মাত্র ১৭ জন সাক্ষীর বক্তব্য দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে। এই ১৭ জন সাক্ষীকে বক্তব্য প্রদানে বাধা প্রদান করা হয়েছে এবং প্রসিকিউশনে সাক্ষীদেরকে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জেরা করতে বাধা দেয়া হয়েছে। এতো সব প্রতিবন্ধকতার পরেও প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণে মাওলানা সাঈদীকে সাজা প্রদানের মত ন্যূনতম উপাদান না থাকার পরেও তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে। এই রায়ে আমরা সংক্ষুব্ধ। আমরা এই রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করব। আশা করি আপীলে সুবিচার পাব।
সূত্র : দৈনিক সংগ্রাম থেকে নেয়া